“সময়ের ঘষা লেগে শিলালিপি যায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে” সত্যিই তো তাই। আবার সেই সময়ের প্রলেপেই বেঁচে ওঠে কোনো এক প্রাচীন সভ্যতা! দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর শহর। এই শহরেও তেমনি সময় চাপা দিয়ে রেখেছে হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসকে। জেলাসদর বালুরঘাট থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গঙ্গারামপুর। পুনর্ভবা নদীর ধারে গড়ে ওঠা এই শহর যাকে ‘বায়ু পুরাণে’ ও ‘বৃহৎ সংহিতা’য় ‘কোটিবর্ষ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। বহুপ্রাচীন হিন্দু পুরাণ থেকে বাংলায় বখতিয়ার খিলজীর আগমন, এই শহরের নাম পাওয়া যাবে সর্বত্র। অবশ্য,কোথাও কোথাও এর নাম ‘দেবকোট’ অথবা ‘দেবীকোট’ হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। এমনকি মহাভারতেও রয়েছে এই শহরের উল্লেখ। সেই শহরের ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে বাণগড় অন্যতম।
গঙ্গারামপুরের শিববাড়ি এলাকার বাণগড়ের নিদর্শন বয়ে নিয়ে চলেছে, মৌর্য্য, গুপ্ত, শুঙ্গ সাম্রাজ্যের সমকালীন ইতিহাস। মনে করা হয়, শাসক বান রাজার নাম থেকেই এলাকার এই নামকরণ। তবে ঐতিহাসিকরা বাণগড়ের আসল বয়স জানতে না পারলেও, তাদের মতে বাণগড় ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সমসাময়িক। ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ কুঞ্জ গোবিন্দ গোস্বামীর নেতৃত্বে এখানে প্রথম খনন করা হয়। যার ফলে ১৪১ একর এলাকা জুড়ে উঠে আসে নানা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা অবাক করে দেয় তৎকালীন সকল ঐতিহাসিকদের। পরে ১০০০ একর জায়গা জুড়ে হদিস পাওয়া যায় বিশাল আকৃতির পোড়ামাটির মাটির নিদর্শন। বিক্ষিপ্ত নানান জ্যামিতিক আকৃতির পোড়ামাটির স্থাপত্য দেখলে বোঝা যায় এককালে এখানে ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ শহর।
সেই শহরে ছিল সুন্দর নিকাশি নালার ব্যবস্থাও। দীর্ঘ তিন বছরের খনন কার্যে পাওয়া যায় একের পর এক মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন যুগের প্রাচীন মুদ্রা থেকে বিভিন্ন দেব-দেবী এবং নর-নারীর মূর্তি। এছাড়াও এখানে দেখা মিলবে পদ্ম আকৃতির এক বিশেষ কুণ্ডের। কুন্ডের পদ্মের পাপড়ির ন্যায় প্রতিটি গঠনে ছিল আদতে জল নিকাশি ব্যবস্থা। এই বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো বাতাসের তাপমাত্রা! এমনকি এখানে পাওয়া যায় ওয়াচ টাওয়ার এবং পাতকুয়োও। এরপর বাণগড়ও হতাশ করেনি কাউকে। মাটি খোঁড়ার ফলে একে একে জেগে ওঠে নানান লুকোনো ইতিহাস। পাওয়া যায় গ্রানাইটের এক বিশেষ নিদর্শন। এটি নাকি সেই দুর্গের দরজার সামান্য অংশ মাত্র! সেই গ্রানাইট শিলাও এমনি নয়, অত্যন্ত সুন্দর নিখুঁত কারুকার্যতে ভরানো সেই গ্রানাইট। আবিষ্কার করা হয় টেরাকোটার মেঝে থেকে তামার বাসনপত্র। এসবই পাল যুগের সাক্ষী! কিন্তু ইতিহাস মিলেছে সেই বর্তমানেই। গল্প আছে বাণ রাজার কন্যা ঊষাকে নাকি হরণ করেছিল শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র অনিরুদ্ধ। যে পথে হরণ করা হয় সেই পথেরই আজ নাম ‘ঊষাহরণ রোড’।
তবে মানুষ কদর করে না তার ইতিহাসকে। প্রতি শীতে এই এলাকায় হাজির হতো দর্শনার্থীদের দল। বনভোজনের নামে দূষণ ছড়াতো। প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে এখানে বনভোজন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। যদিও করা হয়নি বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ। এটি যে আসলে একটি ‘সংরক্ষিত এলাকা’ তা বোঝা একটু কঠিন। বাণগড়ের যতটা যশ-খ্যাতি প্রাপ্য ছিল, ততটা তার কপালে এখনো জোটেনি। বাণগড় এখনো অপেক্ষা করছে, তার পুরনো গরিমা ফিরে পাওয়ার। যদি সঠিকভাবে গবেষণা এবং খননকার্য এগোয়, কে জানে হয়তো উপমহাদেশের ইতিহাসে জন্ম নিতে পারে এক নতুন অধ্যায়!
Discussion about this post