শারদীয়ার আনন্দ-আয়োজন শেষে চারিদিকে বাজছে বিষাদের সুর। তারই মাঝে গৃহস্থের সংসারে সুখ-সমৃদ্ধির ডালি সাজিয়ে আসতে চলেছেন মা লক্ষ্মী। আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। দুর্গোৎসবের রেশ ধরেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে সাড়ম্বরে পালিত হয় সার্বজনীন লক্ষ্মীপূজাও। ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর-২ ব্লকের হাড়দা গ্রামের ‘মণ্ডল-বাকুল’-এর সার্ধশতবর্ষ প্রাচীন পারিবারিক লক্ষ্মীপূজা তার মধ্যে অন্যতম। পূজা উপলক্ষে ৫ দিনের মেলা ও দেড়শো বছরের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ প্রসাদী জিলিপিই এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। এমনকি, এই জিলিপি বানানোর জন্যই নাকি প্রতি বছর ডাকা হয় নিলাম!
কিংবদন্তী ও জনশ্রুতি অনুসারে, কয়েকশো বছর আগে হাড়দা গ্রামের ‘শুঁড়ি’ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাই ‘মোড়ল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঐ পরিবারগুলিকে বলা হত ‘মণ্ডল-বাকুল’। এঁদেরই পূর্বপুরুষ অক্রূর মণ্ডল স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে পারিবারিক ভাবে এই পূজা আরম্ভ করেন। শুরু ৬০টি পরিবারকে নিয়ে হলেও, সেই সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চারশো। পাশাপাশি, গ্রামের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদেরও স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে এই পারিবারিক পূজা এখন সার্বজনীন উৎসবের রূপ নিয়েছে। প্রসাদী জিলিপির ইতিহাসও সমসাময়িক। বিউলির ডালের গুঁড়ির সাথে আতপ চালের গুঁড়ির মিশ্রণে তৈরী হয় এই জিলিপি। পুজো কমিটির ডাকা নিলামে যিনি সর্বোচ্চ দর হাঁকেন, কেবল তিনিই মেলায় প্রসাদী জিলিপি বিক্রির অধিকার পান। বছরে একবার এই জিলিপি খেতেই দূর-দুরান্ত থেকে প্রতিদিন মেলায় ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। পূজা উপলক্ষে কেজি দরে বিক্রি হয় প্রায় দু’শো কুইন্টাল জিলিপি। এটি সরাসরি দেবীর নৈবেদ্য না হলেও, স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস যে এই জিলিপিতে মিশে থাকে দেবীর আশীর্বাদ!
পূজার মূল দায়িত্ব এখনও পালন করেন মণ্ডলরাই। এই পূজার অপর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী এখানে লক্ষ্মীদেবীর সাথে দেবী সরস্বতীও পূজিত হন। তাঁদের সাথে পূজিত হন পীতবসন ধারী নারায়ণ ও চারজন সখী। সখীরা ‘লুক-লুকানী’ নামে পরিচিত। বংশাপরম্পরায় নির্দিষ্ট ব্রাহ্মন পরিবার এখানে পূজা করেন। চিরাচরিত অন্নভোগের পাশাপাশি লুচি, সুজি, নাড়ু ইত্যাদিও ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। পূজার খরচ প্রায় কয়েক লক্ষ টাকা। গ্রামের মানুষরাই সে খরচ জোগান। কোজাগরীর সন্ধ্যায় এলাকার পুরুষ ও মহিলা সকলেই শঙ্খধ্বনি ও হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে গ্রামের মণ্ডল দিঘির ঘাটে জল ভরতে যান। এই দিঘিতেই প্রতিবছর হয় আতশবাজির প্রদর্শন। পূজা উপলক্ষ্যে পাঁচদিন ধরে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যার মধ্যে থাকে জাদু-প্রদর্শনী ও কলকাতার যাত্রাদলের পালাগান। পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয় নানা ধরণের আকর্ষণীয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাও!
প্রতিপদের ভোরে পুজো শেষ হয়ে গেলেও, ঘট বিসর্জন হয় তৃতীয়াতে। তারপর পাঁচদিনের মেলার শেষে কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। উৎসবের এই পাঁচটি দিনকে আকর্ষণীয় ও বর্ণাঢ্য করে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না পূজা কমিটির সম্পাদক সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। বলাই বাহুল্য, শারদোৎসবের মরশুমে মেয়ে লক্ষ্মীদেবীর পুজোর জাঁকজমক এখানে বোধহয় মা দুর্গার পুজোর চেয়েও বেশি!
চিত্র ঋণ – নিউজ ফ্রন্ট
Discussion about this post