এবার বিসর্জনের পালা শুরু। পাড়ায় পাড়ায় থিম পুজোর ঘনঘটার সাথে মানুষের ভিড় শেষ। চাকচিক্যময় সেলফির যুগে বাঙালির দুর্গাপুজোকে ঘিরে থাকা আবেগ, শ্রদ্ধা, উৎসাহ কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি। আজও অক্ষুন্ন রয়েছে পুজোর নিয়ম-নিষ্ঠা। যেমন বালুরঘাটের হোসেনপুর এলাকার চৌধুরী বাড়ির পুজো। ৩৮৬ বছরে পদার্পণ করল এই পুজো কিন্তু পুরনো সাবেকি নিয়ম আজও সেই আদি ও অকৃত্রিম।
এই পুজোর সূচনা রামপ্রসাদ মন্ডলের হাত ধরে। আত্রেয়ী নদী তখন বয়ে যেত হোসেনপুর এলাকায়। তখন এখানে বসবাস ছিল ১৩টি মন্ডল পরিবারের। আত্রেয়ীর তীরেই গড়ে তোলা হয় মায়ের পুজোর স্থান। পঞ্চমুন্ডীর আসনে স্থাপন করা হয় মাকে। পরে অবশ্য নদীর গতিপথের পরিবর্তন ঘটে। আত্রেয়ী বর্তমানে এখানে পরিণত হয়েছে খাঁড়িতে। আত্রেয়ীর অবস্থান বদলালেও সেই পুজো কিন্তু হয়ে আসছে একই জায়গায়। পরবর্তীতে রামপ্রসাদ মন্ডলের বংশধরেরা ইংরেজদের কাছে থেকে জমিদারী পান। সেখান থেকেই তাঁদের ‘চৌধুরী’ উপাধি প্রাপ্তি। মাকে এখানে সকলে ‘ডাকড়া চন্ডী’ নামেই চেনে। ডাকরা মৌজার অন্তর্ভুক্ত ছিল এই এলাকা। তাই এককালে দুর্গাপুজো বলতে এলাকাবাসী শুধু বুঝত ডাকরার চন্ডী পুজো।
সেই আটচালার মন্দির আজ পাকা ও পরিপূর্ণ। চন্ডী মন্ডপের সামনেই আছে নাট মন্দির। সেখানে ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় চন্ডী মঙ্গলের গানের আসর। দেবীকে সাজানো হয় সোনার অলঙ্কার দিয়ে। তবে আজও দেবী প্রতিমা নির্মাণে ব্যবহার করা হয় না কোনো প্রকার পিন এবং নারকেলের দড়ি। তবে অন্যান্য পুজোর মতো এখানে নেই বলি প্রথা। পুজোর দিন মায়ের নিত্য সেবা আত্তি চলে মিষ্টান্ন ভোগ দিয়ে। তবে অন্নভোগেরও আয়োজন করা হয়। অষ্টমীতে মন্দির চত্বরের ভিড় দেখলে কে বলবে পাড়ার পুজো কেড়ে নিয়েছে সাবেকী পুজোর আবেগ! ওই ভিড়ের ফাঁক দিয়ে হলেও মায়ের মুখ দর্শনে হাজির হয় পুরো এলাকা। অবশেষে দশমী। উমার এবার কৈলাস ফেরার পালা। তবে এই ডাকড়া চন্ডী পুজোয় মেনে চলা হয় কিছু বিশেষ নিয়ম। বালুরঘাটে ডাকড়ার দেবী প্রতিমাই বিসর্জন দেওয়া হয় সব প্রতিমা বিসর্জনের আগে। বিসর্জনের পূর্বে মা দেখা করেন তাঁর দুই বোনের সঙ্গে। কথিত আছে বালুরঘাটের ডাকড়া চন্ডী, বয়রা কালী এবং বুড়া কালী তিন বোন। তাই কোনও বারই ডাকড়া চন্ডী মা তাঁর দুই বোনের সাথে দেখা না করে কৈলাসে ফেরেন না। মাকে সেখানে নিয়ে যেতে হয় কাঁধে চাপিয়ে।
এই পুজোকে ঘিরে গড়ে ওঠা মানুষের ভক্তি বিশ্বাস আজও অমলিন। দশমীতে দালান শূণ্য করে মা ফিরে যান মহাদেবের কাছে। কিন্তু মানুষ পথ চেয়ে বসে থাকেন তাদের ডাকড়া মা কবে আসবে! কারণ এ পুজো যতই পুরনো হোক না কেন সন্তান হৃদয়ে ডাকড়া মায়ের আসন তো ধ্রুবক!
Discussion about this post