মালদহের চাঁচল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। বয়স তবুও প্রায় ৩৫০ বছরের কাছাকাছি। রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু হয় রাজা রামচন্দ্র রায়চৌধুরী আমলে। কথিত আছে,তিনি একদিন দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। চাঁচলের পাহাড়পুর এলাকায় মহানন্দাঘাটে তিনি দেখা পাবেন দেবীর। সেই নির্দেশ মতো রাজা নদীঘাটে যান এবং তিনি দেবী চণ্ডীর বিগ্রহ উদ্ধার করেন। বিগ্রহ ঘাট থেকে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয় চাঁচল রাজবাড়িতে। কিন্তু দেবী আবারও স্বপ্নে নির্দেশ দেন, তাঁর বিগ্রহ যেখানে পাওয়া গিয়েছে সেখানেই তিনি তাঁর ভক্তের পুজো নিতে চান। ফলে সেই বিগ্রহ আবার নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়পুরে।সেখানে নির্মাণ করা হয় মন্দির। দুর্গা পুজোর চারদিন সেখানেই চলে মাতৃ আরাধনা।
তবে এখানে পুজো শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ সূচনার অনেক আগেই। মহাষষ্ঠীর ১২ দিন আগে থেকে, কৃষ্ণা নবমীতে রাজবাড়ি লাগোয়া চন্ডীমন্ডপে শুরু হয়ে যায় ঘট পুজো। মহাসপ্তমীতে মহা ধুমধাম করে রাজবাড়ি থেকে পাহাড়পুরে আনা হয় অষ্টধাতুর মূর্তি। সেখানে মৃন্ময়ী প্রতিমার সাথে নিয়মিত পুজো করা হয় অষ্টধাতু নির্মিত মা সিংহবাহিনীর মূর্তিকেও। দেবী এখানে চতুর্ভুজা। তিনি এখানে আসেন সপরিবারে।
তবে তাঁর আগমনকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে নানা রীতিও। সে অনেক আগের কথা,তখন আগুনের আলোই ছিল রাতের একমাত্র ভরসা। বৈদ্যুতিক আলোর সংজ্ঞা প্রচলন হতে তখনো ঢের দেরি। কিন্তু মা আসছেন, তাঁর আগমনের পথে আঁধার শোভা পায় না। ফলে সেই এলাকার মানুষ বাড়ির দাওয়ায় লন্ঠন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মায়ের পথে আলো দেখাতেন এলাকার মুসলিমরাও। সপরিবারে মন্দিরে দেবী দুর্গা পৌঁছলে, মহাড়ম্বরে শুরু হয় পুজো। অষ্টমীর কুমারী পুজোয় মন্দির চত্বরে লোক জমায়েত হত দূরদূরান্ত থেকে। কোনরকম ত্রুটি রাখা হতো না পুজোর নিয়ম কানুনে। অবশেষে, দশমী। উমার যে কৈলাস ফেরার পালা! তবে পথে তো আলো নেই। শেষমেষ বিসর্জন অন্ধকারে! কদাচিৎ নহে। তাই এদিন ধর্ম ভুলে মায়ের বির্সজন যাত্রায় সামিল হতেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও। লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে মায়ের ফেরার পথে আলো দেখাতেন।
কিন্তু সে সব শতবর্ষ প্রাচীন কথা।আজ দশরথ নেই, নেই তাঁর অযোধ্যাও। বর্তমানে পুজোর সমস্ত দায়িত্ব পালন করে একটি ট্রাস্ট বোর্ড। আর এখন বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে রাস্তাঘাট। তবে আজও মেনে চলা হয় সেই পুরনো নিয়ম। এলাকার মুসলিম বাসিন্দারা আজও ঘরের দাওয়ায় লন্ঠন টাঙিয়ে রাখে মায়ের আগমনে। মাতৃরূপেণ দেবীর পুজোয় খুশির আমেজে মেতে ওঠে রাম-রহিম সকলে। ধর্ম যার যার, দুর্গোৎসব সবার। এই না হলে বাঙালির শ্রেষ্ঠোৎসব! “একই বৃন্তের দুইটি কুসুম” ন্যায় ফুটে ওঠে ভ্রাতৃত্বের ফুল। মা দুর্গার অকাল বোধনে এর থেকে আনন্দ আর অন্য কিছুতে আছে কি!
Discussion about this post