বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বের দিকেই তুলে দিয়েছে প্রশ্ন। এই চরম সংকটের মোকাবিলা করতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতিতে আর কয়েকদিন পরেই বিশ্বের এক প্রান্তে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন তথা কপ-২৬। বিশ্বের অপর প্রান্তে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় তখন তাদেরই পূর্বতন অঙ্গীকারকে বাস্তবায়িত করতে তথা প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষা করতে ক্রমাগত লড়ে চলেছে ‘প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’।
চলতি মাসের ২৭ ও ২৮ তারিখ, অর্থাৎ গতকাল ও আজ এই ‘প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’-এর তরফ থেকে অযোধ্যা পাহাড়ে বনাধিকার স্বীকার আইন (২০০৬) সংক্রান্ত একটি সচেতনতামূলক প্রচার যাত্রার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এই আইনে বলা আছে, গ্রামের পার্শ্ববর্তী বনের উপর সম্পূর্ণ অধিকার কেবল গ্রামবাসীর, আর কারও নয়। এই আইন ও তার সুবিধা সম্পর্কে সকল গ্রামবাসীকে অবগত করা আশু প্রয়োজন। তাই মঞ্চের সদস্যরা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সার্বিক ভাবে যথাযথ করোনা বিধি মেনে অনধিক পঞ্চাশ জন এই যাত্রায় অংশ নেবেন। সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ভাবে সম্পন্ন করা হবে এই কর্মসূচী।
ঠিক কী কারণে এই কর্মসূচী? ২০১৭ সালে এই বনাধিকার স্বীকার আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গ্রামবাসীদের সম্মতি ছাড়াই মিথ্যা বলে বেআইনিভাবে পুরুলিয়ার তৎকালীন জেলাশাসক ঠুড়গা পাম্প স্টোরেজ প্রজেক্ট (TPSP) সহ আরও দুটি প্রকল্প চালু করার চেষ্টা করেন। ফলে ধ্বংসের মুখে পড়তে চলেছে আনুমানিক ১২০০ হেক্টর বনভূমি, অর্থাৎ প্রায় ১০ লক্ষ গাছ। বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্ততঃ ৬২টি গ্রাম। ২০১৮ সাল থেকে কলকাতা হাইকোর্টে এই প্রজেক্ট নিয়ে মামলা চলছে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ গ্রামবাসীদের পক্ষে রায় শোনায়। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ডিভিশন বেঞ্চে যায় সরকার, সেই শুনানি এখনও চলছে। তাছাড়া ট্যুরিজমের নামে কর্পোরেটদের হাতে চলে যাচ্ছে আদিবাসীদের জমি, কলুষিত হচ্ছে তাদের সংস্কৃতিও। শুধু তাই নয়, ট্যুরিস্টদের জন্য বদলে ফেলা হচ্ছে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বসম্পন্ন বিভিন্ন জায়গার নামও। যেমন, আর্টেজীয় কূপ ভুড়ভুড়ি হয়ে গেছে সীতাকুণ্ড। এর পাশাপাশি বাকি অন্যান্য প্রশাসনিক দফতরেও গ্রামবাসীরা নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে চান, যেমন, ডাক্তারের অভাব, সরকারি গণপরিবহনের অভাব, স্কুলে শিক্ষকের অভাব ইত্যাদি। অযোধ্যা এলাকায় অবস্থিত সমস্ত গ্রামের অধিবাসীদের দাবীগুলিকে একটি দাবীসনদে একত্রিত করাও এই কার্যক্রমের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
মঞ্চের এক সদস্যের কথায়, “গতকাল প্রায় ৩০টি গ্রাম মিলিয়ে ১০টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আজ প্রায় ৩৬টি গ্রাম মিলিয়ে ১০-১২টি সভার কথা আছে। প্রতিটি সভাতেই বিপুল জন সমাগম লক্ষ্য করা গেছে। প্রশাসনের তরফে প্রথমে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলেও আমরা যেহেতু গণতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে আইনি লড়াই লড়ছি এবং মানুষকে সচেতন করছি, প্রশাসন পরবর্তীকালে আমাদের সাথে সহযোগীতাই করেছে। এইভাবে অযোধ্যা পাহাড়ের মোট ৬৬টি গ্রামেই আমরা আমাদের প্রচার চালাচ্ছি।” পাশাপাশি গ্রামবাসীদের স্বার্থে সর্বস্তরের মানুষের কাছেই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আশা করছেন তাঁরা। চলতি মাসের ৩০ তারিখ মামলার পরবর্তী শুনানি। আপাতত সেইদিনের প্রতীক্ষাতেই প্রহর গুণছেন মঞ্চের সদস্য ও গ্রামবাসীরা।
Discussion about this post