রাজায়-রাজায় যুদ্ধ একসময় থেমে যায়, কিন্তু রেশ থেকে যায় উলুখাগড়ার জীবনে। ঠিক সেভাবেই, পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলেও, অকল্পনীয় বিপর্যয়ের সাক্ষী হিসেবে থেকে গেছে হিরোশিমা ও নাগাসাকি। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে জাপানের এই দুই শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রাণ হারান দুই লক্ষেরও বেশি মানুষ, যার মধ্যে নাগাসাকিতে সংখ্যাটি ছিল প্রায় আশি হাজার। আজ ‘নাগাসাকি দিবস’ – পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ হল ৭৬ বছর। আজ এত বছর পর জানলে অবাক হবেন, ভয়াবহ এই হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে অবধিও কিন্তু তালিকায় নাম ছিল না নাগাসাকির! অবশেষে তাও কেন দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া গ্রাস করল শহরটাকে?
সময়টা ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাস। আমেরিকার মন্ত্রণালয়ে গোলটেবিল বৈঠকে শামিল হয়েছেন যুদ্ধ বিষয়ক সচিব হেনরি স্টিমসন, আর্মি অফিসার, মিলিটারী জেনারেল ও বিজ্ঞানীরা। প্রসঙ্গ? পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ! জাপানের উপর পার্ল হারবার আক্রমণের প্রতিশোধ নিয়ে পৃথিবীকে যে বুঝিয়ে দিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চোখ তুলে তাকানোর পরিনাম কতটা ভয়াবহ! জাপানের কোন দুটি শহরে নিক্ষেপ করা হবে পারমাণবিক ‘ফ্যাটম্যান আর ‘লিটল বয়’কে, তাই নিয়ে তখন চলছে আলোচনা। ইয়োকোহামা, নিগাটা, হিরোশিমা, ককোরা, কিয়োটো এবং নাগাসাকির মধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে উঠে এল হিরোশিমা এবং কিয়োটোর নাম। প্রায় ২,০০০ বৌদ্ধ মন্দির, ১৭টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, প্রচুর শিল্প-কারখানা, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রায় ১,০০,০০০ মানুষের বসবাস তখন কিয়োটোতে। এমন শহরই তো চাই তাদের পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার স্বরূপ বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য!
কিন্তু কথায় বলে, “অদৃষ্টের ফল, কে খণ্ডাবে বল?” জুনের শুরুর দিকে সবকিছু যখন চূড়ান্ত, তখনই হঠাৎ বেঁকে বসলেন আমেরিকার যুদ্ধ বিষয়ক সচিব হেনরি স্টিমসন। তাঁর দাবি, তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে কিয়োটো। অন্যদিকে বাকি কর্মকর্তারাও নাছোড়বান্দা। এমন আদর্শ স্থান হাতছাড়া করা যায় নাকি! অবশেষে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ স্টিমসন সরাসরি হাজির হলেন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে। অনেক বোঝানোর পর স্টিমসনের প্রস্তাবে রাজি হলেন প্রেসিডেন্ট। তাঁর হস্তক্ষেপেই সেই তালিকায় স্থান পেলো নাগাসাকি। তারপর এল ৯ আগস্ট, সকাল ঠিক ১১টা ২ নাগাদ মানবজাতির ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের জন্য ঘটলো সেই ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
কিন্তু কেন এমন করলেন স্টিমসন? অবিশ্বাস্য লাগলেও, এই ভয়াবহতার উল্টোদিকেই রয়েছে এক নিখাদ ভালোবাসার গল্প! এক শহরের প্রতি স্টিমসনের ভালোবাসাই অন্য শহরকে ঠেলে দিয়েছিল বিপদের মুখে। ১৯২০ সালে ফিলিপাইনের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্বে থাকাকালীন বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তারপর স্ত্রী ম্যাবেলের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা পালন করতে পাড়ি দেন জাপান। হ্যাঁ, কিয়োটোই ছিল তাঁদের গন্তব্য। শহরটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শহরটিকে ভালোবেসে ফেলেন স্টিমসন। নিজের জীবনের সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে যে শহরের সঙ্গে, তার এমন পরিণতি কল্পনা করেই শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন তিনি। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে কিয়োটোকে বাদ দেন সেই তালিকা থেকে, আর পরিস্থিতির শিকার হয় নাগাসাকি। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে মানুষের দুর্বলতা হল তার ভালোবাসা, সেই একই মানুষের মনে এমন নৃশংসতা থাকাও কি সম্ভব? সত্যিই, এই পৃথিবীতে কোন কিছুই বোধহয় অসম্ভব নয়!
Discussion about this post