মুখ ও মুখোশের ভিড়ে মানুষের এখন নাজেহাল অবস্থা। মুখোশের আড়ালে আসল পরিচয় খোঁজাটাই যেন মানুষের প্রাথমিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কুশমন্ডি এলাকা বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করেছে এই মুখোশ দিয়েই! দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুশমন্ডি ব্লক। এখানকার মুখোশ শিল্পের রয়েছে নিজস্ব জিআই ট্যাগ। যদিও মুখোশ স্থানীয় ভাষায় এখানে ‘মুখা’ নামে পরিচিত। হরেক রকমের সেই মুখার রয়েছে নিজস্ব রূপ। ঈশ্বর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ! চামুন্ডা, নরসিংহ,মা কালী,’বুড়ো-বুড়ি’এমনকি বাঘ থেকে সিংহ সকলের মুখোশই ঠিক যেন জ্যান্ত হয়েছে শিল্পীদের হাতে। সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি এক একটি মুখোশ কিন্তু আর পাঁচটা মুখোশের থেকে একেবারেই আলাদা। ফসল কাটার মরশুমে গোমিরার নাচের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই মুখোশ। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস অনুযায়ী ‘অশুভ শক্তি’কে তাড়াতে এবং ‘শুভ শক্তি’কে আহ্বানের জন্যই এই নাচের আয়োজন। তাদের মতে সেইসময় মুখোশে নিজস্ব প্রাণ সঞ্চার হয়।
সাধারণত গামারি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় এই মুখোশ। কখনো-সখনো বাঁশের তৈরি মুখোশ ও পাওয়া যায়। আগে অবশ্য আম,নিম,পাকুর ও ছাতিম গাছের কাঠ ব্যবহৃত হতো মুখোশ তৈরিতে। কিন্তু এসব কাঠে পোকার উপদ্রব হওয়ায় গুণগত মান কমে যেতো। তারপর থেকেই গামারি কাঠের ব্যবহার। আগে রং হিসেবে ব্যবহার করা হতো হাঁড়ির কালি, সিঁদুর, চুন ,সাদা খড়িমাটি। তবে এখন সময়ের বড্ড অভাব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মুখোশ তৈরির কৌশল প্রণালীও। প্রাকৃতিক রঙের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় কৃত্রিম রং। মুখোশটিকে পালিশও করা হয় কৃত্রিমভাবেই। তবে কৃত্রিম তেল পালিশ প্রচলনের আগে তেঁতুল বীজের গুঁড়ো ব্যবহৃত হতো পালিশের কাজে।
প্রতিটি এলাকার লোকশিল্পই ইঙ্গিত করে সেই এলাকার মানুষের রুচি, পছন্দ ও বিশ্বাসকে। কুশমন্ডি ব্লকের এই মুখোশ শিল্প বাংলার ঐতিহ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে প্যারিসে এবং ২০১৬ সালে লন্ডনে পশ্চিমবঙ্গের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছে এই মুখোশ। অথচ ভাববার বিষয়, ১৯৯১ সালে মাত্র ২৭ জন শিল্পীকে নিয়ে বেঁচে ছিল এই শিল্প। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় বাদে এই মুখোশের বিশেষ চাহিদা ছিল না। ফলে শিল্পীদের মন থেকেও হারিয়ে যেতে শুরু করে নতুন মুখোশ তৈরির উত্তেজনা।
পরবর্তীকালে মহিষবাথান হস্তশিল্প সমবায় সমিতির গঠন হওয়ায় এলাকার মানুষজন নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। হাল আমলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ বাংলা নাটক ডট কমের যৌথ উদ্যোগে শুধুমাত্র মুখোশকে ঘিরেই তিন দিনের মেলা বসে এলাকায়। বিদেশ থেকেও আসতে থাকেন বহু মানুষ এই মুখোশ চাক্ষুষ করার জন্য। তবে ধীরে ধীরে সরকারি সহায়তায় এবং মানুষজনের সচেতনতায় মুখোশ শিল্পীর সংখ্যা বর্তমানে ২০০ এরও বেশি। বিভিন্ন সমবায় মেলায় পসার বসায় মহিষবাথানের এই সমিতি। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসতে থাকে বড়সড় অর্ডার। বহু খদ্দেরও এখন আগ্রহী এই মুখোশ কিনতে। কারণ এই মুখোশ ঘর সাজানোর অতি উত্তম এক সামগ্রী। তাহলে আর কী! কোনও মেলায় যদি দেখা মেলে এই মুখোশের, কিনে নেওয়াই যায় নিজের পছন্দমত একখানি। তাল ঠুকে বলাই যায়, ঘরের অতিথির চোখ ফেরাতে এই মুখোশ একাই একশো।
Discussion about this post