“যাও গান পরমাণু বোমাটাকে ধর, পারলে পোখরানে একটু চাষ বাস কর।” হ্যাঁ, সঙ্গীতের ক্ষমতা রয়েছে দিন বদলের। সঙ্গীত পারে স্বপ্ন দেখাতে। তবে এই স্বপ্নটা খানিক আলাদা। শ্রীরামপুরের সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আস্তাকুঁড়ে আমাদের ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে বানাচ্ছেন তাক লাগিয়ে দেওয়া সব বাদ্যযন্ত্র। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আবিষ্কার হল তথ্যের খনি।
আপনার এই কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা কী ছিল?
এটা বলতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আমার বাবা নীরদ বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৮ সাল নাগাদ থাকতেন বেলেঘাটায়। নিমতলা থেকে কাঠ কিনে নিয়ে এসে ইউরোপীর জাইলোফোনের অনুকরণে তৈরি করেন স্বদেশী বাদ্য যন্ত্র তৈরি করেন। এটির তিনি নাম দেন ‘কাষ্ঠ তরঙ্গ’। এর পর পন্ডিত রবিশঙ্কর, তিমিরবরণ ভট্টাচার্য, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, অনুপম ঘটকের মতো মানুষ বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরবর্তী কালে বাবা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৬০ সালে ‘লক্ষ্মী নারায়ণ’ সিনেমায় নীরদ বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পান। সন্ধ্যা রায়, পান্নালাল, নির্মলেন্দু চৌধুরীর মতো নামী শিল্পীরা বাবার সুরে গান গেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সাল থেকে অসুস্থতার কারণে বাবা বাইরে না বেরতে পারলেও নোটেশন দেওয়ার কাজ জারী ছিল। ১৯৭৬ সালে বাবা বাঁশ তরঙ্গ তৈরি করলেন। আমি এবং আমার দাদা নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে নানা জায়গায় অনুষ্ঠানও করেছি। বাবা ১৯৮২ সালে মারা যান। ১৯৮৫ সালে শ্রীরামপুর কলেজের নবীন বরণে আমার শেষ পারফর্ম ছিল। এরপর তিন দশকের এক বিশাল বিরতি।
২০০৭-এ আমার বিয়ে হয়। আমার স্ত্রী জানতেন না বাবার এই কর্মকান্ডের কথা। সন্তান হওয়ার পর তার যখন দেড় বছর বয়েস, তখন কাষ্ঠ তরঙ্গ এবং বাঁশ তরঙ্গ নিয়ে টুং টাং বাজিয়ে শোনাতাম। স্ত্রী তখন থেকেই বিষয়টি জেনে আমাকে উৎসাহ দিতে শুরু করেন। এই বয়েসে এসে একটি বেসরকারি জায়গায় কাজ করে এই সঙ্গীত চর্চা নতুন করে শুরু তো সম্ভবই ছিল না। স্ত্রীই তখন বাবার স্মৃতিতে একটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ দিলেন। ২০১০ সালে আমাদের এই ঘরেই শুরু হল নীরদ বরণ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সন্ধ্যা। পরের বছরগুলিতে যখন ঘরে জায়গা দিতে পারলাম না, তখন চলে গেলাম হলে।
২০১৫ সালে ঘরের মেঝেতে সেরামিক টাইলস বসছে। হঠাৎ একটি আওয়াজ পেলাম যা বেশ কানে লাগল। ওপরে এসে মিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন হাত থেকে একটি টাইলস পড়ে গিয়েছে। ফের মিস্ত্রিকে আমার সামনেই ওই টাইলস মাটিতে ফেলতে বললাম। যে আওয়াজ এল তাতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মাথায় ঘুরপাক খেল অন্য চিন্তা। বাবা ঠিক যে মাপে কেটে বাঁশ তরঙ্গ অথবা কাষ্ঠ তরঙ্গ তৈরি করেছিলেন। আমি কি সেরকম কিছু চেষ্টা করে দেখতে পারিনা? আমি তক্ষুনি মিস্ত্রিকে দিয়ে টাইলসের ৩-৪ টে টুকরো কাটিয়ে নিলাম। তারপর বাক্সের ওপর বসিয়ে দেখলাম অদ্ভুত এক আওয়াজ বেরচ্ছে। এভাবেই শুরু হল সঙ্গীত জীবনের ঘটনা বহুল দ্বিতীয় পর্ব। এরপর আত্মবিশ্বাসকে হাতিয়ার করে বানিয়ে ফেললাম টালি, কাঁচ, সসের বোতল দিয়ে বাদ্যযন্ত্র।
আপনার তৈরি বাদ্য যন্ত্র কি সবসময় গানের সুরেই বাজে? নাকি তাতে মৌলিক সুরও সৃষ্টি হয়?
বাদ্যযন্ত্রকে আপনি যেভাবে কথা বলাতে চাইছেন সে কিন্তু সেভাবেই কথা বলবে। সে আমি এখানে কোন গানও বাজাতে পারি, রাগও বাজাতে পারি অথবা কোন মৌলিক সৃষ্টিও বাজাতে পারি। আমি তো আলাদা করে তালিম পাইনি। তাই আমি গান শুনলাম, তারপর সেটিকে যন্ত্রে তুলে নিয়ে বাজাই। মূলতঃ এতে গান শুনতেই ভালো লাগে।
এখনও পর্যন্ত কী কী বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছেন?
সেরামিক টাইলস কেটে সেরামিক ফ্লোর টাইলস তরঙ্গ, কাঁচ কেটে কাঁচ তরঙ্গ, সসের বোতল দিয়ে বোতল তরঙ্গ। মাটির যে টালি হয়, সেটা কেটে পোড়া মাটি তরঙ্গ। এই চারটে বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছি এখনও পর্যন্ত। দরজা জানলার গ্রিল, প্লাস্টিকের বোতল এগুলো দিয়েও কাজ চলছে, বানাতে চাই যন্ত্র। বলে রাখি, আমার যে শিক্ষা তা একেবারেই পুঁথিগত নয়। আমার ভেতর থেকে যেটা আসে, সেটাই করি। এর বিজ্ঞান যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আমি কিন্তু বলতে পারবো না।
আজও যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মানুষ গান বা নাচের পারফরম্যান্স দেখতেই বেশি ভিড় করেন। সেখানে যন্ত্রসঙ্গীতের দাপট আমরা কবে দেখতে পাবো?
আমরা গানটাই বেশি শুনতে ভালবাসি, তারপর নৃত্য, তারপরে যন্ত্র সঙ্গীত। যেমন আর ডি বর্মণের সময়ে তাঁর কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছি। এত সুন্দর যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনা করেছেন ওনার টিম। শুধু যন্ত্র শোনার আগ্রহ মানুষের একটু হলেও কম। আগে সেই আগ্রহ যথেষ্টই ছিল, যা ইদানিং কমে গিয়েছে। এখন ওয়েস্টার্নের যুগে মানুষ গানের সঙ্গে বিভিন্ন বাজনা উপভোগ করছেন।
এই লক ডাউন কী দিল আপনাকে ?
প্রথম লক ডাউনে চলাকালীন সময়ে একদিন বাজারে নারকেল আনতে গেলাম। আসলে কী হয়! নাম করা শিল্পী তো কোনও দিন হতে পারবো না। কিন্তু একটা শিল্পী মন তো রয়েছে। ছাড়ানো নারকেলের সঙ্গে হঠাৎ ঢোলের মিল খুঁজে পেলাম। পরে মাপ করে সেই নারকেল কাটলাম। তারপর তবলার দোকান থেকে চামড়া এনে লাগালাম। যেহেতু বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজো হয় তাই জরির সাজের জিনিসপত্র বাড়িতেই মজুত থাকে। সেই দিয়েই ঢোলে যেভাবে দড়ির টান থাকে, সেভাবেই আমি দিয়েছি। এগুলো হয়তো বাজবে না। কিন্তু ঘরে শো-পিস হিসেবে সাজিয়ে রাখা যাবে। তারপর এভাবেই একে একে তানপুরা, বীণা, সেতার, ড্রামের সেট, খমক তৈরি করি। সামাজিক মাধ্যমে এটি ছাড়ার পর এটিও ভাইরাল হল। সবাই দাম জিজ্ঞাসা করতেন। যদিও এগুলি বিক্রির কথা ভাবিনি। মাস ছয়েক হল মানুষের চাহিদাকে সম্মান জানিয়ে আমি আমি এগুলির বিক্রিতে ঢুকে যাই।
এখানেই শেষ নয়। এই সব বাদ্যযন্ত্রের স্বত্ত্বের দিকেও তিনি দিলেন উদারতার পরিচয়। এই বরেণ্য শিল্পীর বক্তব্য, কেউ যদি এই যন্ত্র বানাতে চায়, বানাক। আমার তাতে কোন আপত্তি নেই, অনেকেই আমাকে এই যন্ত্র বানানো নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, আমি সদুত্তর দিয়েছি যথাসাধ্য।
Discussion about this post