ইতিহাসের ছোঁয়া যে খালি প্রাচীন দুর্গ বা প্রাচীন পরিকাঠামোকেই ঘিরেই পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়। আমাদের আসেপাশে কত যে ঐতিহাসিক স্থান বর্তমান তা কখনো কখনো আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই না। সেইরকমই একটি অঞ্চল হল বারাসাত যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। বারাসাতের বিখ্যাত তিতুমীর বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া একটি বিনোদন পার্ক হল ‘সিরাজ উদ্যান’। যার নামের মধ্যে আজও ঐতিহ্য বহমান। এই পার্কটির কেন্দ্রস্থলে আছে একটি জলাশয় বা পুকুর। যা হাতিপুকুর নামে পরিচিত। এই ‘হাতিপুকুর’ নামটি আজও বহন করছে বহু যুগের ইতিহাস।
ভারতবর্ষে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব চলছে রমরমিয়ে। শুরুর দিকে কলকাতা ছিল ইংরেজদের কাছে জলা-জঙ্গল ও খানা-খন্দে ভরা অস্বাস্থ্যকর একটি জায়গা। সেই সময় কলকাতার কাছে বারাসাত অঞ্চলে হেস্টিংস সাহেব তৈরি করেছিলেন হেস্টিংস ভিলা। তার পর থেকেই এই বারাসাত ও তার পার্শবর্তী অঞ্চল ইংরেজদের নজরে পড়ে এবং তাদের আনাগোনা শুরু হয়। ধীরে ধীরে তাদের আমোদ প্রমোদের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে এই এলাকা।
সেই সময় মুর্শিদাবাদে বসে বাংলার মসনদ সামলাচ্ছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে মাঝে মধ্যেই কলকাতা আসতেন নবাব৷ সাথে থাকত সৈন্য সামন্ত ও হাতি ঘোড়া। এই বিশাল যাত্রাপথের মাঝে পড়ত বারাসাত। হেস্টিংস ভিলার কাছাকছি ছিল এক বিশাল বড় ময়দান। যা এখন কাছারি ময়দান নামে পরিচিত। এই কাছারি ময়দানেই নবাবের সৈন্য সামন্ত, হাতি ঘোড়া দুই দন্ড বিশ্রাম নিত। এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথের কারনে নবাব কাছারি ময়দান ও হেস্টিংস ভিলার কাছে এক পুকুর খনন করিয়েছিলেন তার হাতি-ঘোড়াদের জল খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে। কথিত আছে এই পুকুরেই নাকি জল খেত নবাবের হাতি ঘোড়া। সেই থেকেই এই পুকুরের নাম হয় ‘হাতিপুকুর’।
যদিও দীর্ঘদিনের অবহেলায় ও অযত্নে হাতিপুকুর ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছিল তার ঐতিহ্য। কয়েক বছর আগে এই অঞ্চলটিকে সংস্কার করা হয়। সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি বিনোদন পার্কের রূপ দেওয়া হয়। পার্কটির কেন্দ্রস্থলেই রয়েছে সেই পুকুরটি আর পুকুরটির মাঝে অবস্থান করছে একটি দ্বীপ। বহু পুরোনো আমলের একটি শিরিষ গাছ আজও অক্ষত দ্বীপে। যদিও গাছটি এখন ভগ্ন কিন্তু গাছের গুঁড়িটি সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে৷
বর্তমানে এই সিরাজ উদ্যান বারাসাতের একটি বিখ্যাত বিনোদন পার্ক। এটির ঐতিহাসিক রূপটিও সকলের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। রয়েছে টয় ট্রেন ও বোটিংয়ের ব্যাবস্থাও। এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হোক। বিলুপ্তপ্রায় ইতিহাসের ফের হোক পুনর্নির্মাণ। নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাক তাদের আঞ্চলিক ইতিহাস। এটুকুই তো কাম্য, তাই না!
চিত্র ঋণ – https://soumyajyotibiswas.blogspot.com/
Discussion about this post