প্রেয়ারলাইনের গান নিয়ে প্রথম জোকটা শুনেছিলাম বাবার মুখে। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে জোর করে ভর্তি করা রবীন্দ্রনাথ নাকি ঘাড় নেড়ে গাইতে শিখেছিলেন “কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং মেলালিং!” ছোটবেলায় আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে তো জন্মে ইস্তক দাড়িওয়ালা জোব্বা পরা একটা বুড়ো_নয়_কিন্তু_বুড়োমত লোক। সে আবার প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে উদ্ভট গান গাইছে, এটা ভাবতেই কেমন কেমন লাগত! বেশ কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত কল্পনা করতে পেরেছিলাম, জোব্বা পরা লম্বা দাঁড়ির একটা খুদে মানুষ। অনেকটা সাত বামনের এক বামনের মত দেখতে। ইংরেজি গাইতে গিয়ে ওরম হিজিবিজি করে ফেলেছে! গানের আসল লাইনটা ছিল “ফলো মি, ফুল অফ গ্লী, সিংগিং মেরিলি মেরিলি মেরিলি!”
ইংরেজি শিক্ষার বা শিক্ষণ পদ্ধতির প্রাথমিক গোলমালেই ওই দশা। ইংরেজি হোক বা বাংলা, এইরকম প্রমাদ প্রার্থনা সঙ্গীতে কিছু না কিছু থাকবেই। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গাওয়ানো হত দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারের গান ‘ভবসাগর-তারণ’। তাতে ‘ত্রয়তাপ’, ‘রিপুসূদন’, ‘হৃদিকন্দর’- কীসব বিস্ফোরক শব্দ! আর সেগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে ঝুঁটিওয়ালা-নেড়ামুণ্ডু-হাফস্কার্ট-হাফপেন্টুলদের কী কেলেঙ্কারি অবস্থা! এছাড়া ছিল রজনী সেনের গান ‘তুমি নির্মল করো’। এ গানের প্রথম লাইন সব্বাই গাইত “তুমি নির্মল করো মঙ্গল ক’রে মলিন মর্ম মুছায়ে”। গানে তুমি-সূচক ঈশ্বরকে বলা হচ্ছে তাঁর মঙ্গলময় হাত দুটি (বা চারটি, ছ’টি, দশটি, যাই হোক) দিয়ে জীবনের মালিন্যগুলিকে ধুয়ে নির্মল করে দিতে। অর্থাৎ, “নির্মল করো মঙ্গল করে”। এখানে সেই ‘হাতে’-টা হয়ে যাচ্ছে ‘ক’রে’- অসমাপিকা ক্রিয়া। মানে, আগে বাবা মঙ্গলটা করে নাও, তারপর নির্মল করতে এসো। আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে!
ইস্কুলের আধফোটা বুলিতেই হোক বা আন্তর্জাতিক খেলার মঞ্চের জুলুসেই হোক, জাতীয় সংগীতের উপস্থিতি তো প্রত্যাশিত। তার ডাকনাম ‘জনোগণো’। ইয়ার বন্ধুমহলে অন্ত্যাক্ষরী খেলায় জ-সূচক গানে আকাল পড়লেই জনগণ ভরসা। তার সঙ্গে বাঁধা রসিকতা “গাইছিস গা, উঠে দাঁড়াতে পারব না।” ইদানীং একে ‘জ্যানাগ্যাণা’ বলেও ডাকা হয়। হিন্দি উচ্চারণে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার এক বিদঘুটে প্রবণতা বেশ কয়েক বছর হল শুরু হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রশিক্ষণ আর সরকারি সম্প্রচারণের জন্যই মূলতঃ এই অবস্থা। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সিনেমায় ব্যবহৃত না হলে হাফ কোটি বাঙালি হয়ত জানতই না যে জ্যানাগ্যাণা আসলে একটি বাংলা গানের স্তবক। জিনিয়াস লেখক লোকটি কেবল এই একটি স্তবকেই এমন ভাষাগত তারল্য তৈরি রেখেছেন যাতে একে বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত, যেকোনো ভাষার লেখা হিসেবেই বলা যেতে পারে। রামকৃষ্ণ মিশনে প্রায় এরকম গান হিসেবেই আছে স্বামী বিবেকানন্দ-রচিত গান ‘খণ্ডন ভব-বন্ধন জগ বন্দন বন্দি তোমায়’। অপূর্ব তার সুর, কিন্তু প্রশিক্ষণ না থাকলে কেমন গাওয়া হয়, তা নিয়ে ভুরি ভুরি গপ্পো মিশনের প্রাক্তন পড়ুয়াদের ভাঁড়ারে মজুত থাকে। যাই হোক, ‘জনোগণো’ গানটা যখন প্রেয়ারলাইনে গাওয়া হয়, তখন অবধারিতভাবে একদল নাক উঁচু সুপারশিক্ষিত বালক-বালিকা প্রাণপণে গাইতে চেষ্টা করে ‘উচ্ছ্বল জলধি-তরঙ্গ’, আর আরেকদল তাদের এই চেষ্টায় কর্ণক্ষেপ না করে জলধিত-রঙ্গ নিয়েই তুমুল তৃপ্ত। এই সজল রগড়ের ট্রাডিশন বহু পুরাতন।
এই ‘জ্যানাগ্যাণা’ প্রজন্মের প্রার্থনা গানে বাংলা গান নেই বললেই চলে। ছড়ার গানেও সাহেব-সাহেব ভাব। অথচ, হিরে মানিকের অভাব কিন্তু নেই বাংলা ভাষায়। মাইকেলের মত ‘অবোধ অবহেলা’ করে শেষমেশ ঘরে ফিরতেও কি পারব আমরা? ‘জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’-এর দরকার নেই, নিজেদের লালমেঝেতে পাতা শেতলপাটিখানা থাকলেই তো চলবে।…
Discussion about this post