”সুজলাং সুফলাং শস্য-শ্যামলা মলয়জশীতলা রূপসী বাংলা”- এই বাংলার রঙ্গশালায় কতই না রূপ কতইনা ঐশ্বর্যের বিলাস।শস্য শ্যামলা এই বাংলা আদি কাল ধরেই ইতিহাসের পাতায় দাগ কেটে গেছে। এই ইতিহাসে পাতায় আছে দেশ ভাগের যন্ত্রনা, অহেতুক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর রক্তের দাগ। প্রযুক্তিকে পরিণতি দিতে গিয়ে সেই প্রযুক্তিই যে মানুষের জীবনে বিপত্তি ডেকে আনে তার প্রমান ইতিহাসের পাতায় কম নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম হল বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা যা ১৮৬০ সালে লর্ড ক্যানিংয়ের ২২ তম প্রশাসনিক আদেশক্রমে সৃষ্টি হয়। পাহাড়-পর্বতে ও বন দিয়ে ঘেরা এই অঞ্চলটির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা কর্ণফুলি নাদীকে ঘিরে মূলতঃ সমস্যার সূত্রপাত।
সমস্যা শুরু হয় বাঁধ নির্মাণের সময় থেকেই। এই বাঁধ তৈরির সময়কালে প্রায় ৬৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয় যার মধ্যে ছিল ২২ হাজার একর ফলনশীল জমি। শুধু তাই নয়, কাপ্তাই হ্রদ নিমার্ণে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়। যার মধ্যে ৭০ শতাংশই চাকমা জনজাতির মানুষ। যার ফলে এই অঞ্চলের মানুষেদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল ক্ষোভ, যার বিভিন্ন সময়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ আমলে কর্ণফুলি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কে প্রথম চিন্তাভাবনা শুরু হয় । শেষ পর্যন্ত ১৯৫১ সালে সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী খাজা আলিমুদ্দিনের তত্তাবধানে কাপ্তাইকে শেষ পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণের চূড়ান্ত স্থান হিসাবে বাছা হয়। শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান সরকারের আমলে বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। কাজটি শেষ হয় ১৯৬২ সালে। সেই সময়ে বাঁধে জল র্নিগমন পথ, জলকপাট ও দুটি ৪০ মেগা ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কাপলান টারবাইন জেনারেটর তৈরি করা হয়। পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে সফল হয়েছিল তৎকালীন সরকার।
কাপ্তাই বাঁধটি প্রধানত মাটি ভরাটের মাধ্যমে তৈরি হয় যা দৈর্ঘ্যে ৬৭০ মিটার ও প্রশস্তে ৪৫.৭ মিটার চওড়া। ১৯৬২ সালের ৩০শে মার্চ যখন এই বাঁধটির প্রাথমিক কাজ শেষ হয় তখন এর মোট উতপাদিত বিদ্যুৎতের পরিমান ছিল ৮০ মেগাওয়াট যা বর্তমানে ৫ টি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট ও মোট ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎতে এসে দাঁড়িয়েছে। এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দারাই ছিলেন গরিব আদিবাসী। এই বাঁধ নির্মাণের সময় যে ১ লাখ মানুষকে বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল পুনর্বাসনের কোনরকম ব্যবস্থা ছাড়াই। শুধু তাই নয় তাদের মতামত নেওয়া তো দুরস্ত, তাদের একপ্রকার জোর করেই ওই এলাকা থেকে তাড়ানো হয়। ফলে একপ্রকার জোর করেই মানুষগুলোর খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা যায় যখন বাঁধের কাজ শুরু হয় তখন কিছু মানুষকে কাংসাল উপত্যকায় নিয়ে আসা হয় ও বসবাস উপযোগ্য জায়গা দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৬২ সালে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার পর এই অঞ্চলটিও প্লাবিত হয়। এরপর তখনকার পাকিস্তান সরকার আর তাদের কোনোরকম পুর্নবাসনের ব্যাবস্থা নেয়নি।
বিশেষত এই উদ্যোগ না নেওয়ার পিছনেও ছিল বেশ কিছু কারণ। এতো সংখ্যক মানুষদের পুর্নবাসনের জন্য যে পরিমান অর্থ ও চাষ যোগ্য জমির প্রয়োজন তা তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। শুধু তাই নয় তারা তাদের নায্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল। বাঁধ নির্মাণের শুরুতে আদিবাসী নেতারা এই প্রকল্পের বিপক্ষে ছিল।পরিবেশবিদরাও এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করে, মানুষগুলোকে ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর প্রায় ৪০ হাজার চাকমা অধিবাসী ভারতের অরুণাচল প্রদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন। এই শরণার্থীদের ‘পরিবেশগত কারণে সৃষ্ট শরণার্থী’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই মানুষগুলো এখন রাষ্ট্রহীন। ভারত, বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান কোন দেশেরই নাগরিকত্ব নেই এই অভাগাদের। বর্তমান দিনে কাপ্তাই বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে কর্ণফুলির সমতলে চাষিরা লাভবান হয়েছে, মাছ চাষ এবং পর্যটন-বিনোদনের ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলটি অনেক সমাদর পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় যে লক্ষাধিক গরিব আদিবাসী মানুষগুলোর নিজেদের বাসভূমি, দেশ, স্বজন হারানোর কান্না রয়ে গিয়েছে। সেগুলো কি এত সহজে মুছে ফেলা যাবে!
কভার চিত্র ঋণ – ফারহানা শরিফ
Discussion about this post