বাঙালির কাছে ঠাকুর বলতে আজও রবীন্দ্রনাথ। আমাদের জীবন শুরুর ‘সহজ পাঠ’ থেকে জীবন ‘শেষের কবিতা’ জুড়ে রয়েছেন যিনি। প্রেমের কবি রবি ঠাকুরের কলমে বারবার উঠে এসেছে বিরহ, ব্যাকুলতা, ভালবাসার শব্দ। না পাওয়ার কষ্ট ফুটে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে বোধ হয় তাঁর এই লেখনীকে অনুভব করেছি আমরাও। তাঁর অত্যন্ত তরুণ বয়েসের লেখাতেও আমরা সেই না পাওয়ার বেদনা লক্ষ্য করেছি। প্রথম প্রেম এসেছিল তাঁর জীবনেও। এসেছিল এক তরুণ লেখকের মনে প্রথম প্রেমের এক ঝলক টাটকা বাতাস হয়ে।
“শুন নলিনী, খোল গো আঁখি, ঘুম এখনো ভাঙ্গিল না কী! দেখ, তোমারি দুয়ার-’পরে সখি এসেছে তোমারি রবি।” লিখেছিলেন রবি ঠাকুর তাঁর কিশোর বয়েসের প্রেমিকার প্রতি। না নলিনী তাঁর আসল নাম না। এ নামও তরুণ রবিরই দেওয়া। প্রথম প্রেমের ঝড় তখন তরুণ রবির বুকে। কবিতায় গানে শুধু তাঁর সেই প্রথম প্রেমের ছোঁয়া পরতে পরতে ফুটে উঠছে। জীবনের ‘গল্পগুচ্ছ’ গুলির মধ্যে এটি ছিল রবি ঠাকুরের জীবনের অন্যতম স্মৃতিময় অধ্যায়। নলিনীর সাথে পরিচয় তাঁর ১৭ কি ১৮ বছর বয়েসে। নলিনীর বাবা আত্নারাম তর্খদ, পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। তাঁরা সঙ্গে রবি ঠাকুরদের পারিবারিক সূত্রে বন্ধু ছিলেন। কবিগুরুর দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন আত্নারাম তর্খদের পরিচিত। তাঁর হাত ধরেই এক প্রকার এই দুই বাড়ির যোগাযোগ হয়েছিল।
নলিনীর আসল নাম অন্নপূর্ণা তর্খদ। ব্রিটেন ফেরত এই রমণীর সাথে বন্ধুত্ব হলে রবির ইংরেজির দক্ষতা আরো বাড়বে এই ভেবেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। এই উদ্যেশেই তরুণ রবিকে ১৮৭৮ সালে পাঠানো হয় বোম্বেতে। আর এই বন্ধুত্বই পরবর্তীকালে প্রেমের এক পবিত্র সম্পর্কে পরিণত হতে শুরু করে। কিন্তু কিশোর বয়েসের প্রেম সমাজের সাত পাঁচ তথাকথিত নিয়ম কানুন জানেনা। তাঁদের প্রেমে তাই অচিরেই বাধা পড়ে। অন্নপূর্ণা রবির থেকে বয়েসে ছিলেন বড়ো এবং জাতিতে ছিলেন মারাঠি। যদিও সত্যেন্দ্রনাথ ও আত্মারাম এই সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর ঠিক করেন তাঁদের বিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেন নি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পিতার আদেশ অমান্য করার কথা রবীন্দ্রনাথ কখনো কল্পনা করতে পারে না। আর এভাবেই জীবনের প্রথম ক্ষতের সম্মুখীন হন তরুণ রবি ঠাকুর। কিন্তু জীবনের শেষ দিন অবধি তিনি ভুলতে পারেন নি তাঁর নলিনীকে। সাহিত্যের লেখায় অমর করে গেছেন তাঁর জীবনের প্রথম প্রেমকে।
রবি যাকেই আঁকড়ে ধরতে গেছেন তাঁদের সবাইকেই হারিয়েছেন। তাঁর লেখায় তাই বিরহ এবং না পাওয়ার বেদনা আমরা দেখতে পাই বারবার। কিন্তু প্রথম বিচ্ছেদের ব্যাকুলতা বোধ হয় সবথেকে বেশি ক্ষত রেখে যায়। রবীন্দ্রনাথ বিদেশ যাওয়ার পরে নলিনীর বিয়ে হয় ১৮৮০ সালে এবং তিনি চলে যান স্বামীর সাথে এডিনবার্গে। জানা যায় মাত্র ৩৩ বছর বয়েসে ১৮৯১ সালে মৃত্যু হয় অন্নপূর্ণার। কিন্তু রবির প্রেমে ব্যর্থতা এবং বিরহের দিনে চলা কলমে নলিনী বেঁচে আজও। “উজল অসিত-তারা-নয়না! অমনি চকিত এক হাসির ছটায় ললিত কপোলে তার গোলাপ ফুটায়, তখনি পলায় আর রয় না!” আমরা যা সহজে বুঝিয়ে উঠতে পারিনা তা কবিরা কী সহজেই লিখে ফেলতে পারেন। সৃষ্টি করে ফেলেন এক একটি অমর কাব্যগ্রন্থের। অমর রয়ে যায় তাঁদের প্রেম কাহিনী গুলো এভাবেই। বেঁচে থাকে তাঁদের না পাওয়া গুলি।
Discussion about this post