বাংলাকে নিয়ে বিজাতিদের চক্রান্তের শেষ নেই। কতবার যে কতশত বিদেশীর জবরদখল চলেছে বাংলায় গোনা দায়। আসলে বাংলার সম্পদ আর ভৌগোলিক অবস্থানটা ব্যবসার ক্ষেত্রে একদম সোনায় সোহাগা। আর তাই এত কুনজর। তা সে কারণ যাই থাক আক্রমনের মাত্রা প্রতিবারই ছিল ভয়ঙ্কর। আর সেইসব বিজাতির মধ্যে যারা বারবার বাংলাকে দখলে আনতে চেয়েছে তারা হল মারাঠা। যাদের আমরা বর্গী বলেই জানি।একধরনের ছুঁচলো বর্শা নিয়ে যুদ্ধ করত মারাঠাসেনা। যেগুলোকে মারাঠি ভাষায় ‘বরচি’ বলা হয় আর তা থেকেই এসেছে বর্গী শব্দটি। এই বর্গী জাতিটি যে কত কৌশল করেছে বাংলাকে অধিকারে আনতে ইতিহাস না ঘাঁটলে বিশ্বাস করবেন না।
সালটা ১৭৪১। আলিবর্দি খান তখন বাংলকে শাসন করেছেন। এদিকে তাঁরই শ্যালক রুস্তম জং নবাবী আসন থেকে আলিবর্দিকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। রুস্তম তাই আমন্ত্রণ দিলেন মারাঠা সেনাপতি রঘুজী ভোঁসলেকে। শুরু হল বাংলা দখলের ষড়যন্ত্র। মারাঠাজাতির সাহায্যেই রুস্তম ওড়িশা নিজের করলেন। আর এদিকে মারাঠারাও মহা আনন্দে ওড়িশায় নিজেদের ঘাঁটি করে নিল। এইভাবেই শুরু হয় বাংলায় বর্গী লুঠপাটের অধ্যায়টা। কালো পোশাক আর মাথায় লাল ফিতে জড়ানো ৩০ কি ৪০ জনের একটা দল। সংকেত ছাড়াই হর হর মহাদেব বলে ঝাঁপিয়ে পড়ত তারা নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর। ধীরে ধীরে বর্ধমান থেকে হুগলি মেদিনীপুর যশোহরের বিভিন্ন অংশে ঢুকে পড়ে এরা। ক্ষেতের পর ক্ষেত লুঠ করে নয়তবা জ্বালিয়ে শেষ করে দিত বর্বর এই জাতি।
পরিস্থিতির হাল ধরতে বর্গীদের হারিয়ে ওড়িশাকে নিজের অধীন করলেন নবাব। কিন্তু মারাঠারা বাংলার পিছু ছাড়েনি। রঘুজী দেওয়ান ভাস্কর পন্ডিতকে অশ্বারোহীর প্রধান করে পাঠালেন বাংলায়। পাঞ্চেত থেকে সোজা ঢুকে পড়লেন বাংলাতে। আবার শুরু হয় বর্গী লুঠ। আলিবর্দি এবার রাজ্য বাঁচাতে নিলেন অসৎ উপায়। চুক্তি বৈঠকে ভাস্কর পন্ডিতকে আমন্ত্রণ জানালেন। বৈঠক চলাকালীন পেছন থেকে হত্যা করে আলিবর্দির ঘাতক দল। কিন্তু ভাস্কর পন্ডিত মারা গেলেও তার বর্গী বাহিনী অত্যাচার চালিয়ে বাংলাকে করে শ্মশান ভূমি। ১৭৪৩ রঘুজী আবার বাংলা আক্রমণ করলেন। নবাব এবার মারাঠা সম্রাটের সাথে চুক্তিতে বসলেন। ঠিক হল নবাব মারাঠা সম্রাটকে কর দেবেন, তার বদলে মারাঠারা বাংলা ছেড়ে চলে যাবে। এরপর নবাবের আফগান সৈন্যদের বিদ্রোহের সুযোগে আবার ঢোকে বর্গীরা।
তবে গঙ্গা-হুগলি নদী বহুবার বর্গী আক্রমণ প্রতিহত করতে সহায্য করেছিল। আলিবর্দি ও তাঁর সেনাপতি মীরজাফর বর্গীদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করেছে বারবার। ১৭৫১ সালে নবাবের সঙ্গে রঘুজির চুক্তি হয়। যার শর্ত নবাব মারাঠাদের প্রতি বছর কর দেবেন, তার বদলে মারাঠারা আর বাংলা-বিহার আক্রমণ করবে না। বর্গীদের আসা যাওয়া বাংলায় লেগেইছিল দশটা বছর ধরে। কিন্তু বাংলার সম্পদের সাথে সামরিক বাহিনীও যে চিরকাল তুখোড়। মায়ের কোলে বর্গী দস্যু আসার ছড়া শুনে বাংলার ছেলেমেয়েরা বড় হয়। কিন্তু এটা হয়তো অনেকেই জানেন না যে বহুবার লুঠতরাজ চালালেও বাংলার মাটিতে বর্গীরা রাজত্ব করতে পারেনি কোনোদিন।
Discussion about this post