জাদুকরের ভেলকিতে বোকা বনতে বাধ্য হন আট থেকে আশি বয়সের যে কোনও মানুষ। চোখের ভুলকে কাজে লাগিয়ে নিমেষে বেকুব বানাতে ম্যাজিশিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। ফ্রান্সের রবেয়ার উদ্যাঁ ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব যাঁর হাতসাফাইয়ের নিপুণতা চর্চিত হয় ইতিহাসের পাতায়। ১৮০৫ খ্রীস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন জাদুবিদ্যার বরেণ্য ব্যক্তিত্ব রবেয়ার উদ্যাঁ। ১৮৫৬ সাল নাগাদ ফ্রান্সের দখলে থাকা উত্তর আফ্রিকার আলজিরিয়ায় আরব ধর্মযাজকরা প্রবেশ করেন। নানারকম হাতসাফাইয়ের ম্যাজিক দেখিয়ে আলজিরিয়ানদের বশীভূত করে আরবনিবাসীরা। ফরাসিদের হারানোর লক্ষ্যে আলজিরিয়ানরা আরব ধর্মযাজকদের ইন্ধনে বিদ্রোহ ঘনীভূত করে। অন্যদিকে, ফ্রান্সও সরাসরি সামরিক আঘাতের বদলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার বন্দোবস্ত করে। ম্যাজিকের উত্তর ম্যাজিক দিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ডাকা হয় রবেয়ার উদ্যাঁকে।
দলবল নিয়ে আলজিরিয়া চষে বেড়াতে লাগলেন রবেয়ার উদ্যাঁ। প্রথমে অতটা পাত্তা না দিলেও ধীরে ধীরে ভিড় জমে উঠতে লাগল উদ্যাঁর চারিপাশে। রবেয়ারের ম্যাজিকগুলির মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল মানুষ অদৃশ্য করার ভেলকি। একজন আরব দর্শককে মঞ্চের উপর ডেকে তাঁকে ঝুড়ি দিয়ে চাপা দিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করার পর যখন ঝুড়ি তোলেন রবেয়ার, দেখা যায় বেমালুম গায়েব দর্শক! গায়েব হয়ে যাওয়ার ভয়ে মঞ্চের আশপাশ থেকে পালাতে লাগলেন আলজিরিয়াবাসী।
এমনই আরেকটি ভয়ংকর ম্যাজিকের উদ্ভাবন করেন রবেয়ার। প্লেটে বন্দুকের গুলি রেখে দর্শককে পরীক্ষা করতে দিতেন তিনি। দর্শকের মনে সন্দেহের অবকাশ না থাকলে উদ্যাঁ তখন পিস্তলে সেই গুলি ভরে এক দর্শককে তাঁর দিকে ফায়ার করতে বলতেন। ফায়ার করার পরে দেখা যেত রবেয়ারের দাঁতে আটকে সেই গুলি। এরপর হঠাৎই হাসতে হাসতে বন্দুক নিয়ে রবেয়ার ঘোড়া টিপে দিতেন দেওয়ালের দিকে তাগ করে, দর্শকরা দেখতেন দেওয়াল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। এই ম্যাজিকের ফলে অনেকের মনে ধারণা জন্মায় রবেয়ার উদ্যাঁ অমর। ম্যাজিক দেখে ভয়ে অজ্ঞানও হয়ে যান অনেকে।
রবেয়ারের সর্বাধিক তাকলাগানো খেলা হচ্ছে ‘হালকা ও ভারী বাক্সের খেলা’। উদ্যাঁর নির্দেশে একটি শিশু সহজেই একটি বাক্স মঞ্চ থেকে তুলে জায়গামত রাখে। এরপর উদ্যাঁ শক্তিশালী এক জোয়ানকে বাক্সটি তুলতে বলেন। লোকটি অবলীলায় বাক্সটি তুলে রাখে। এবার উদ্যাঁ সেই লোকটির দিকে জাদুকাঠি লক্ষ্য করে বলতেন, “তোমার সব শক্তি কেড়ে নিচ্ছি। তুমি এখন শিশুটির চাইতেও দুর্বল, এবার তুমি বাক্স তুলে দেখাও।”এইবার লোকটি শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করেও বাক্সটিকে একচুলও নাড়াতে পারল না। উল্টে বৈদ্যুতিক শক খেয়ে স্টেজের একপাশে গিয়ে আছড়ে পড়ল। এরপর উদ্যাঁ বাচ্চাটিকে পুনরায় বাক্স তুলতে বললে বাচ্চাটি খুব সহজেই তা তুলে দেখাল। উদ্যাঁ তখন লোকটির দিকে জাদুকাঠি ইঙ্গিত করে বলতেন, “আমি তোমার সব শক্তি আবার তোমার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি। এবার চেষ্টা করো।”লোকটি এরপর অনায়াসে বাক্সটি তুলে ফেলে।
রবেয়ারের এমন চমকপ্রদ ক্ষমতার কথায় ভয় পেয়ে যায় আরব শাসকরা। আলজিরিয়ানদের বশ করার কৌশল ছেড়ে তারা রবেয়ার উদ্যাঁর কাছে নতিস্বীকার করে। ফ্রান্সের শান্তির দূত রবেয়ারের দৌলতে এভাবেই বিনা রক্তপাতে দমন করা সম্ভব হয় একটি আস্ত বিদ্রোহ! সত্যিই যেন জাদুকাঠির মন্ত্রবলে সমগ্র আরব ও আলজিরিয়ার ‘শক্তি’ কেড়ে নেন আধুনিক জাদুবিদ্যার জনক রবেয়ার উদ্যাঁ।
Discussion about this post