বিপ্লব আর প্রেম কি কখনও এক গতিতে চলতে পারে? হয়ত পারে। কিন্তু প্রেমের অমোঘ টানে নিজের শত্রুকে হত্যা করা থেকেও কি পিছু হটতে পারে মানুষ? নিজের সত্ত্বাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সেই শত্রুরই টানে নিজেকে কি উৎসর্গ করতে পারে? নাহ! সবাই হয়ত পারেন না৷ তবে কেউ কেউ অবশ্যই তা পারেন। এরকমই একজন ছিলেন তিনি। ছিলেন আমেরিকান এক গুপ্তচর। অথচ প্রেমের মোহে ভেসে গিয়ে গুপ্তঘাতক আর হয়ে উঠতে পারলেন না। কারণ নিজের শত্রুই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। তিনি, মারিতা লরেঞ্জো৷ আর তাঁর সেই অমোঘ শত্রুটি ছিলেন কিউবার বিপ্লবী এবং রাজনৈতিক নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। যাঁর প্রেমের টানেই নিজেকে জড়িয়েছিলেন মারিতা। তাঁকে আর হত্যা করা হয়ে উঠল না তাঁর।
কিউবার সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী ও নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে প্রায় ৬৫০ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। সেরকমই একজন গুপ্ত ঘাতক ছিলেন মারিতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই এবং সিআইএর গোপন তথ্যদাতা এবং গুপ্তচর হিসাবে জীবনের দীর্ঘ কিছু বছর তিনি কাটিয়েছিলেন৷ অবশ্য হবে নাই বা কেন! তাঁর মা এবং বাবাও তো ডাবল এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন বহু বছর৷ তাই গুপ্তচর বৃত্তি তো তাঁর রক্তেই। তিনি ছিলেন এমন এক গুপ্ত ঘাতক, যাঁর লাস্যময়ী চাহনিতে ঘায়েল হত বহু শত্রুই। এমনকি বহু শত্রুর রাতের ঘুমও কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। জীবনে কোনও মিশনে তিনি ব্যর্থ হননি। শুধু সেই একটি বারই নিজের কাজ সফলে অক্ষম হন তিনি। তাঁর সামনে পথ রোধ করে দাঁড়ায় ভালোবাসার প্রাচীর। সেই প্রাচীর ভেঙ্গে সামনে এগোনো আর সম্ভব হয়নি তাঁর। নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন শত্রুর হাতে। ফিদেল কাস্ত্রো, তাঁর প্রথম প্রেম। তাঁকে কি করেই বা হত্যা করবেন তিনি? অথচ তাঁকে মারার জন্যই তো কিউবায় গেছিলেন তিনি।
সালটা ১৯৬০। কিউবায় গুপ্তচরের বেশে গেলেন মারিতা। উদ্দ্যেশ্য ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা। তিনি তখন আমেরিকার শত্রু। যে শত্রুর শেষ রাখতে নেই। কিউবায় পৌঁছে সুযোগের অপেক্ষায় বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করলেন মারিতা। অবশেষে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন৷ কিউবার হাভানা হিলটন হোটেলের ২৪০৮ নম্বর ঘর৷ এই ঘরেই ছিলেন কাস্ত্রো। সেই ঘরে এলেন মারিতা। তাঁর সঙ্গে ছিল ‘বটুলিজম’ নামের ট্যাবলেট। যে কোনও পানীয়তে মিশিয়ে দিয়ে শত্রুকে খাওয়াতে পারলেই সব শেষ৷ চিরদিনের মত পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন ফিদেল। কিন্তু হায়! নিজের প্রথম ভালোবাসাকে এভাবে হত্যা করা কি মুখের কথা! কাস্ত্রোকে দেখা মাত্রই দুজনে ভেসে গেলেন নস্টালজিয়ায়। মারিতাও বুঝলেন ফিদেলকে হত্যা করতে তিনি পারবেন না। তাঁকে মারিতা হত্যা করতে এসেছেন শুনেই নিজের লোডেড পিস্তল তাঁর হাতে তুলে দিলেন কাস্ত্রো। কিন্তু কোথায় কি! মারিতা পিস্তল ফেলে দিতেই দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুজনের বুকে। সেদিন হিংসা, হানাহানি এবং বিপ্লবের মাঝেও তখন ফুটে উঠেছিল তাদের ভালবাসার গোলাপ।
সেই প্রথম এবং সেই শেষ। সিআইএর দেওয়া নিজের মিশন সফল করতে ব্যর্থ হন মারিতা। হোটেলের ঘরেই ঘুমন্ত কাস্ত্রোকে ফেলে তিনি আবার ফিরে আসেন আমেরিকায়। নিজের আগামী মিশনের কাজে। এবং এরপর আরও বহু মিশনই তিনি দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিয়েই সফল করে তুলেছিলেন। কোনও মিশনই অপূর্ণ রেখে ফেরেননি আর। তবে শুধু ওই একটিমাত্র বার। তিনি হার স্বীকার করেছিলেন তাঁর আবেগের এবং ভালোবাসার কাছে। মারিতা পারেননি নিজের প্রথম প্রেমকে নিজের হাতেই খুন করতে। নিজের ভালোবাসার জন্য কত মানুষই তো কত কিছুই না করে। মারিতাও করেছিলেন। ভালোবেসেছিলেন মন প্রাণ দিয়ে। তাই হেরেছিলেন নিজের প্রেমিকের কাছেই। সে হার তো তীব্র সুখের। আজ ইতিহাসে হয়ত সেভাবে তাঁর নাম নেই। তবে কাস্ত্রোর প্রেমিকা হিসাবে চিরদিন মানুষের মনে রয়ে গেছেন তিনি, ‘দ্য স্পাই হু লাভড কাস্ত্রো’।
Discussion about this post