প্রতিবেদক মীর মনাম হোসেন
শীতের আগমনী বার্তা মানেই একসময় ছিল বাংলার গ্রামের মেঠো পথে গাছিদের তুমুল ব্যস্ততা আর উৎসবের আমেজ। কার্তিক মাসের শুরু থেকেই খেজুর গাছ ঝুড়ে ফেলার তোড়জোড় শুরু হতো প্রতিটি গ্রামজুড়ে, যা আজ শুধুই স্মৃতির পাতায় উঁকি দেয়। কোমরে দড়ি বেঁধে আর হাতে ধারালো দা নিয়ে গাছিরা নিপুণ দক্ষতায় গাছের বাকল চাঁছতেন, যা ছিল এক নিখুঁত শৈল্পিক দৃশ্য। প্রতিটি গাছকে সন্তানের মতো যত্ন করে প্রস্তুত করা হতো ফোঁটা ফোঁটা মিষ্টি রস সংগ্রহের আশায়। পড়ন্ত বিকেলে গাছে হাড়ি বাঁধার ধুম পড়ত, আর কুয়াশাভেজা ভোরে সেই হাড়ি নামানোর দৃশ্য ছিল চিরায়ত বাংলার এক মুগ্ধকর রূপ। গাছিদের এই বিরামহীন কর্মযজ্ঞে মিশে থাকতো গ্রামীণ মানুষের কঠোর পরিশ্রম আর ভালোবাসার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন।
বাড়ির উঠোনে উনুনের ওপর বিশাল কড়াইয়ে সারাদিন ধরে রস জ্বাল দেওয়ার সেই মিষ্টি সুবাস আজও অনেকের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। আগুনের হালকা আঁচে রস যখন ক্রমশ ঘন হয়ে আসত, তখন তার সোনালি-লাল রঙ আর গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। দক্ষ কারিগরের নিপুণ হাতে তৈরি হতো দানাদার পাটালি বা আঠালো ঝোলা গুড়, যা ছিল শীতের পিঠে-পুলির প্রাণভোমরা। ভাপা, চিতই, পুলি কিংবা দুধচিতইয়ের সঙ্গে খেজুর গুড়ের সেই মিতালি বাঙালির রসনা বিলাসের এক অনন্য ও অবিস্মরণীয় অধ্যায়। মা-চাচিদের হাতে তৈরি নকশি পিঠেতে মিশে থাকত মমতা আর ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ, যা আজ যান্ত্রিকতার আড়ালে ক্রমশ ম্লান হতে বসেছে। সেই ধোঁয়া ওঠা পিঠের স্বাদ আর পারিবারিক আড্ডার উষ্ণতা ছিল শীতের প্রধান আকর্ষণ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হতো।
কাঁচা খেজুর রস খাওয়ার সেই অনুভূতি আজও হৃদয়ে গভীর নাড়া দেয় এবং মনকে নস্টালজিক করে তোলে। হাড় কাঁপানো শীতে চাদর গায়ে দিয়ে ভোরবেলা গাছতলায় জড়ো হতেন গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা, যা ছিল নিত্যদিনের চিত্র। মাটির ভাঁড়ে বা কাচের গ্লাসে সরাসরি হাড়ি থেকে ঢেলে ঠাণ্ডা রস চুমুক দেওয়ার সেই স্বাদ ছিল নন্দনলোকের অমৃতের মতো অতুলনীয়। রসের সেই হিমশীতল স্পর্শ শরীরে কাঁপন ধরালেও, মনে ছড়িয়ে দিত এক অদ্ভুত উষ্ণ প্রশান্তি ও সজীবতা। সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই রস শেষ করার যে তাড়া ছিল, তা যেন ছিল এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা। সেই সরল আনন্দ, নির্মল হাসি আর প্রকৃতির নির্যাস আস্বাদনের দিনগুলো আজ আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ সেই আনন্দঘন ও প্রাণবন্ত দিনগুলোতে হানা দিয়েছে অদৃশ্য এক আতঙ্ক, যার নাম নিপা ভাইরাস। বাদুড়ের লালা বা বর্জ্য থেকে ছড়ানো এই মারণব্যাধি আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে এক গভীর ও বিষাক্ত ক্ষত তৈরি করেছে। চিকিৎসকদের কড়া সতর্কবার্তায় কাঁচা রস খাওয়া এখন আক্ষরিক অর্থেই নিজের প্রাণের ঝুঁকি নেওয়ার শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে গ্রামের সেই চিরচেনা গাছ কাটার দৃশ্য, রস সংগ্রহের ধুম বা পিঠে উৎসবের আমেজ এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা বাধ্য হয়ে হারাতে বসেছি আমাদের শেকড়ের এক অনবদ্য ও গর্বের অংশ। ভাইরাসের নির্মম চোখ রাঙানিতে নস্টালজিয়ার সেই পথ আজ রুদ্ধ। খেজুর রসের ঐতিহ্য ক্রমশ বিলীন হচ্ছে ইতিহাসের অতল গহ্বরে। আর রেখে যাচ্ছে শুধুই দীর্ঘশ্বাস।






































Discussion about this post