স্বাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাসে বহু নাম চাপা পড়ে গেছে। তবু হঠাৎ কোনও পুরনো বস্তু আবার ফিরে এসে মনে করিয়ে দেয় – লড়াই কেবল অস্ত্রের নয়, চেতনারও। সুলেখা কালি সেই স্মৃতি জাগানো নাম। এর নীল-কালো রঙে শুধু কালি ছিল না, ছিল স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধতার গন্ধ। রাজশাহীর এক সাধারণ পরিবারের উঠোনে শুরু হওয়া এ কালি ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছিল দুই বাংলার লেখার অভ্যাস। দেশজুড়ে যখন স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল সময়, তখনই শুরু হয় দেশি কালি তৈরির চেষ্টা। গান্ধীর বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক শুনে প্রশ্ন জাগে, স্বদেশি আন্দোলনের কথাই যদি বিদেশি কালিতে লেখা হয়, তবে লড়াই কতটা সত্যি? এই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন পথ।
এই পথ আলোকিত করেন মহাত্মা গান্ধী ও সতীশ চন্দ্র দাস গুপ্ত। সেই আলো গিয়ে পৌঁছায় রাজশাহীর মৈত্র পরিবারে। সত্যবতী মৈত্রের সাহস আর অম্বিকাচরণ মৈত্রের সঞ্চয়ে ননীগোপাল ও শঙ্করাচার্য মৈত্র গড়ে তোলেন রাজশাহীর প্রথম সুলেখা কারখানা। ঘরের নারীরা বানাতেন কালি, পুরুষেরা ছুটতেন বাজারে। ১৯৩৪ সালে ‘সুলেখা-ওয়ার্কস’ শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই কলকাতায় শো-রুম হয়। ননীগোপাল তাঁর চাকরির সমস্ত আয় ঢেলে দেন এই কাজে। ধীরে ধীরে সুলেখা ছড়িয়ে পড়ে বৌবাজার, কসবা, যাদবপুর – যেখানে পরে ‘সুলেখা মোড়’ নামটি স্থায়ী হয়ে যায়। ৮০-র দশকে এটি হয়ে ওঠে পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় কালি প্রস্তুতকারক। মাসে লাখ লাখ বোতল কালি বিক্রি হত। দেশভাগের পর বাংলাদেশে সরবরাহ থেমে যায়। তারপর শ্রমবিরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ১৯৮৯ সালে বন্ধ হয়ে যায় কারখানা।

তবু ইতিহাস কি কখনও শেষ হয়? প্রায় দুই দশক অন্ধকারে থাকার পর ২০০৬ সালে সুলেখা আবার ফিরে আসে। প্রথমে হোমকেয়ার পণ্য নিয়ে। পরে ২০২০ সালে ফিরে আসে লেখার কালি নিয়ে। বাংলাদেশেও একই বছরে মিজানুর রহমান মিজানের উদ্যোগে বাঁচিয়ে তোলা হয় রাজশাহীর সেই পুরনো নাম। এখন ‘স্বদেশী’, ‘স্বরাজ’, ‘স্বাধীন’ নামে পাওয়া যায় সুলেখা কালি। পুরনো স্মৃতি আবার ফিরে আসে দুই বাংলার লেখার টেবিলে। আজও মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই বিজ্ঞাপন – “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।” ছোট অথচ যথাযথ ট্যাগলাইন। তার সঙ্গে চমৎকার উপমার প্রয়োগ। একদিকে ক্ষুরধার লেখনী আর অন্যদিকে কবিগুরুর এন্ডোর্সমেন্ট। এই দুইয়ে মিলে বাজারে সেই সময় ‘সুলেখা’ কালির দারুণ ব্যবসা করেছিল।
সুলেখা যে শুধু একটি পণ্যের নাম নয়, তার প্রমাণ রয়েছে সাহিত্য-ইতিহাসে। তারাশঙ্কর, হাসান আজিজুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, সত্যজিৎ রায় – অসংখ্য লেখক লিখেছেন এই কালিতে। ফেলুদার গল্পেও দেখা গেছে সুলেখার ব্লু-ব্ল্যাক দোয়াত। একসময় শরণার্থীদের কাজ দিয়েছিল সুলেখা। আবার স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে জায়গা করে নিয়েছিল লেখকদের হৃদয়ে। আজ বাজারে বিদেশি কালির ভিড়। বৈচিত্র্যও নানা রকম। তবু সুলেখার নাম উঠলেই ফিরে আসে পুরনো দিনের গন্ধ। মনে পড়ে যায়, এই কালি শুধু অক্ষর লেখেনি, লিখেছে স্বপ্ন, প্রতিবাদ আর এক জাতির অহংকার।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – পিনাকপাণি






































Discussion about this post