চন্দননগর আর কৃষ্ণনগর— জগদ্ধাত্রী পুজোর নাম উঠলেই সবার আগে এই দুই শহরের কথাই মনে পড়ে। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা, আর পরে তাঁর নায়েবের হাত ধরেই চন্দননগরে এই পুজোর প্রচলন। আজও এই দুই শহরে শতাধিক প্রাচীন পুজো রয়েছে, যেগুলো বহন করে আসছে এক অটুট ঐতিহ্য। কিন্তু কলকাতাও পিছিয়ে নেই— শহরের নানা বনেদি বাড়িতে আজও সমান ভক্তিভরে পালিত হয় জগদ্ধাত্রী পুজো। তেমনই এক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পুজো হচ্ছে দর্জিপাড়ার রায়বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো, যার ইতিহাসে মিশে আছে এক অলৌকিক কাহিনি।

রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চল থেকে আজ থেকে প্রায় ৪৫০ বছর আগে ব্যবসার সূত্রে বাংলায় পা রাখে রায় পরিবার। সপ্তগ্রাম হয়ে তারা আসেন কলকাতায়, এবং ধীরে ধীরে কলুটোলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে স্থায়ী হন। বর্তমানে এই পরিবারের অন্তত ২৫টিরও বেশি বাড়ি রয়েছে কলকাতাজুড়ে। পরিবারের বংশধর বদন চাঁদ রায় প্রায় ১৬৮ বছর আগে শুরু করেন দুর্গাপুজো, যা আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা এই বাড়িতে ঘটে এক অদ্ভুত, প্রায় অলৌকিক ঘটনার পর।
১৯২৮ সালে এই পরিবারের এক সদস্যা, সুলক্ষণা দাসী, বাড়ির আঙিনায় মাটি খুঁড়তে গিয়ে হঠাৎই খুঁজে পান এক প্রাচীন মাটির জগদ্ধাত্রী মূর্তি। অল্প সময়ের মধ্যেই সুলক্ষণা দেবীর স্বপ্নে দেবী জগদ্ধাত্রী আবির্ভূত হন, এবং তাঁকে পুজোর নির্দেশ দেন। সেই থেকেই শুরু হয় এই পরিবারের জগদ্ধাত্রী পুজো, যা আজ টানা ৯৭ বছর ধরে চলছে। যদিও আদি মূর্তিটি পরবর্তীতে চুরি হয়ে যায়, এবং তার আদলে তৈরি হয় বর্তমান অষ্টধাতুর মূর্তি, যিনি আজও রায় পরিবারের কুলদেবী ‘বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী’ রূপে পূজিতা।
রায়বাড়ির মন্দিরের কেন্দ্রে দেবী জগদ্ধাত্রী বিরাজমান, তাঁর ডানপাশে জগন্নাথদেব এবং বাঁ পাশে গোপাল ও নারায়ণশিলা। সপ্তমী থেকে নবমী— এই তিন দিন ধরে চলে কঠোর নিয়মে পূজা। এই সময় বাড়ির ভেতরে আমিষ আহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নবমী তিথিতেই হয় মূল পুজো— সংকল্প থেকে আরতি, সন্ধিপূজা থেকে উপবাস ভঙ্গ পর্যন্ত প্রতিটি আচার পালিত হয় গভীর ভক্তিভরে।
দেবীকে সাজানো হয় ঐতিহ্যবাহী গয়নায়; অর্পণ করা হয় ১০৮টি পদ্মফুল, বেলপাতা ও গোলাপের মালা। অষ্টমীর পরে বাড়ির মহিলারা করেন এক বিশেষ আচার— ‘ধুনো পোড়ানো’। মাথায় গামছা রেখে, হাতে ধুনো ও খড় নিয়ে তাঁরা দেবীর সামনে বসেন। বিশ্বাস, সেই সময় তাঁদের উপর দেবীর ভর হয়, আর পরিবারের অন্য সদস্যরা এই দেবীরূপী নারীদের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। পুজো শেষে শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয় চকলেট— দেবীর আশীর্বাদস্বরূপ ‘প্রসাদ’। নবমীর পরদিন ভাসানের মাধ্যমে শেষ হয় পুজো।
এক সময় এই বাড়ির আরতির সময় সত্যিই এক ময়ূর এসে পাখনা মেলে নেচে উঠত— আজও সেই স্মৃতি পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। আধুনিকতার ভিড়ে সেই দৃশ্য হারিয়ে গেলেও, পুজোর আবেগ ও পারিবারিক ঐক্যের আলো আজও নিভে যায়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রায়বাড়ির এই জগদ্ধাত্রী পুজো শুধু এক পারিবারিক পূজা নয়, কলকাতার এক জীবন্ত বনেদি ঐতিহ্য— যা আজও শহরের কোলাহলের মধ্যেও নিঃশব্দে বয়ে চলেছে নিজের গৌরবময় উত্তরাধিকার।






































Discussion about this post