বাংলার দুর্গোৎসবের ইতিহাসে বসিরহাটের বসু বাড়ির ‘কলারছড়া দুর্গা পুজো’ এক অনন্য অধ্যায়। পাঁচ শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এই পুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং ঐতিহ্য, বিশ্বাস, পারিবারিক বন্ধন এবং লোককথার সমাহার। আজও মহালয়ার আগেই বসুবাড়ির ঠাকুরদালান রং-রোগান, মেরামতি এবং পুজোর প্রস্তুতিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা এ সময় একত্রিত হন এবং পুজোর বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সামাজিক মিলনমেলা। ইতিহাস, কাহিনি এবং প্রথার সমন্বয়ে এই উৎসব স্থানীয় মানুষের হৃদয়ে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে।

ইতিহাস অনুসারে, বসুবাড়ির দুর্গা পুজোর সূচনা হয়েছিল ১৪৬০ থেকে ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের দ্বিতীয় স্ত্রীর পিতা ঈশ্বরীগুপ্ত বসু এই পুজো শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মাহিনগর থেকে বসু পরিবার বসিরহাটের দণ্ডিরহাটে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে এবং জমিদারি গড়ে তোলে। কথিত আছে, রাজা প্রতাপাদিত্য নিজেও পুজোয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। যদিও প্রথমে এই পুজোর নাম ছিল না ‘কলারছড়া দুর্গাপুজো’, তবুও তার ঐতিহ্য ও আচার আজও অপরিবর্তিত। মহালয়ার দিন বাগবাজার ঘাট থেকে গঙ্গা জল আনার রীতি, প্রতিপদের দিন ঘট পুজো এবং পঞ্চমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন পাঠা বলির অনুষ্ঠান আজও চলমান। দেবীর আরাধনায় ঠাকুরদালানের সামনে পুরনো বেলগাছ থেকে একটি জোড়া বেল উৎসর্গ করা হয়।

‘কলারছড়া’ নামের পিছনের কাহিনিও সমান আকর্ষণীয়। ১৭৯৩ সালে যখন মহামায়ার প্রতিমা তৈরি হচ্ছিল, বারবার দেখা যায় যে দশটি হাতের মধ্যে আটটি হাত ভেঙে যাচ্ছে। বহুবার মেরামতি করেও সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। পরিবারের সদস্যরা আশঙ্কায় ভুগতে থাকেন এবং অবশেষে ১৭৯৭ সালে পরিবারের কর্তা গোপাল বসু স্বপ্নাদেশ পান – পেছনের আটটি হাত ছোট করে দিতে হবে। সামনের দুটি হাত স্বাভাবিক থাকলেও পেছনের আটটি হাত ছোট করে দেওয়া হয় এবং সেটি যেন কলার ছড়ার মতো দেখায়। এরপর আর হাত ভাঙার সমস্যা হয়নি এবং তখন থেকেই প্রতিমার নাম হয় ‘কলারছড়া দুর্গা’। এই নাম এবং কাহিনি আজও পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে আলোচিত।
বসুবাড়ির গৌরব শুধু পুজোর আচারেই নয়, পরিবারের ঐতিহ্যেও। বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ – ‘হাল নেই, হেঁতোল নেই, জগবন্ধু ডাক্তার!’—এই পরিবারের সন্তান ডাক্তার জগবন্ধু বসুকে কেন্দ্র করেই তৈরি। তিনি একসময় ব্লেড দিয়ে জটিল অপারেশন করতেন এবং প্রসব করাতেন। তাঁর নামেই বসুবাড়ি ‘ডাক্তারবাড়ি’ নামে খ্যাত হয়। অতীতে এই পুজোকে কেন্দ্র করে জমিদার বাড়িতে বসত বড় মেলা, যাত্রাপালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভুরিভোজ এবং কালীপুজো পর্যন্ত উৎসব চলত। যদিও এখন আগের সেই জাঁকজমক নেই। তবুও ঐতিহ্যের ছোঁয়া, পারিবারিক ঐক্য এবং সংস্কৃতির ঐশ্বর্য বজায় রেখেছে এই পুজো। পাঁচশো বছরের ইতিহাস নিয়ে বসুবাড়ির ‘কলারছড়া দুর্গা পুজো’ আজও সমাজের ঐক্য, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য প্রতীক।
চিত্র ঋণ – তারক চন্দ্র কর
Discussion about this post