বাংলার ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন আজও টিকে আছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তনের ঢেউ এলেও পুজোর রীতি-বিধিতে হারিয়ে যায়নি পটচিত্রের মাধ্যমে দেবী দুর্গার আরাধনা। মাটির প্রতিমার বদলে কাপড়ে আঁকা দেবীর রূপ এখনও সমান শ্রদ্ধায় পূজিত হয়। বিষ্ণুপুর মল্ল রাজবাড়িসহ কয়েকটি পুরোনো পরিবারে এই পটদুর্গার পুজো পালিত হচ্ছে বহু প্রজন্ম ধরে। একদিকে থিম পুজোর জৌলুস, অন্যদিকে ঐতিহ্যের সংরক্ষণ – এই দুইয়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে পটের দুর্গা পুজো, যা বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক মূল্যবান উত্তরাধিকার।

ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা বংশানুক্রমে এই পটচিত্র তৈরির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের কাছে এটি কেবল একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাধনার অংশ। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণাষ্টমী বা জিতাষ্টমীতে বড় ঠাকুরানির পট তৈরি শুরু হয়। এরপর মেজো ঠাকুরানি এবং ছোট ঠাকুরানির পট তৈরি করে মল্ল রাজবাড়িতে পাঠানো হয়। পাশাপাশি শহরের কাদাকুলি মহাপাত্র বাড়ি, আইকাত বাড়ি, চক্রবর্তী বাড়ি, ভট্টাচার্য বাড়ি ও কুচিয়াকোল রাজবাড়িতেও এই পটের দুর্গা পৌঁছে যায়। একেকটি পট তৈরি করতে দুই-তিন সপ্তাহ সময় লাগে। কাপড়ের ওপর শিরিষ ও তেঁতুল বীজের আঠা দিয়ে প্রস্তুত পৃষ্ঠে খড়ি মাটি ছড়িয়ে স্কেচ করা হয়, এরপর রঙ দিয়ে শেষ করা হয় দেবীর রূপায়ণ।

রাজ পুরোহিত সোমনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, এই পুজো প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক। ব্রাহ্ম সমাজের মতো যেখানে মূর্তিপুজো ছিল না, সেখানে পটে দেবীর আরাধনা প্রচলিত হয়েছিল। তাঁর মতে, বড় ঠাকুরানি, মেজো ঠাকুরানি এবং ছোট ঠাকুরানির পটে পুজো করা অর্থাৎ মহাসরস্বতী, মহালক্ষ্মী ও দশম স্কন্ধ কালীর পুজো আজও বিদ্যমান। এটি কেবল পুজোর পদ্ধতি নয়, বরং বাংলার আধ্যাত্মিক চর্চার ধারাবাহিকতা রক্ষার এক অনন্য উদাহরণ।

পটশিল্পী সন্দীপ ফৌজদার জানিয়েছেন, এই কাজ তাঁদের পরিবারে বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। দাদু ও জেঠ্যুর কাছ থেকে শিখে তিনি নিজে এখন এই ঐতিহ্য রক্ষায় যুক্ত। বড় ঠাকুরানির পুজো শুরু হওয়ার পনেরো দিন আগে থেকেই কাজ শুরু হয়। তিনি বলেন, যতদিন এই পুজো চলবে ততদিন তাঁরা এই পটচিত্র তৈরির কাজ করে যাবেন। দুর্গার পাশাপাশি লক্ষ্মী, সরস্বতী ও মনসার পটও তৈরি করেন তাঁরা। এই শিল্পরীতি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেনি, বরং বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চাকে ধরে রাখার এক অনন্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্য, শিল্প ও বিশ্বাস – এই তিনের সমন্বয়ে আজও পটদুর্গার পুজো বাংলার সংস্কৃতির এক জাগ্রত উত্তরাধিকার।
চিত্র ঋণ – সৌমেন পাত্র, গৌতম দাস
Discussion about this post