কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাস খুঁজতে গেলে বারবার সামনে আসে এক অমোঘ নাম—সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। আজ থেকে চার শতাব্দীরও বেশি আগে, মোটামুটি ১৬১০ সাল, কলকাতা তখনও আধুনিকা কলিকাতা হয়ে ওঠেনি, তখন থেকেই এই পরিবার শুরু করে দুর্গোৎসবের আয়োজন। অর্থাৎ ইংরেজ আমলের বহু আগেই গঙ্গার ধারে জমিদারদের প্রাসাদে প্রতিমা স্থাপিত হয়।
১৬০০ সালে প্রথম হালিশহরে পুজোর সূচনা হলেও, মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী সেই পুজোকে নিয়ে আসেন কলকাতায়। আর সেই থেকে শুরু, ১৬১০ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত কলকাতাতেই চলে আসছে এই পুজোর ধারা। সে যুগে দুর্গা প্রতিমার প্রচলিত রূপ ছিল একচালা—একই ফ্রেমে মা দুর্গা, সঙ্গে দুই পাশে রামচন্দ্র ও মহাদেব। দেবীর গায়ের রঙও ছিল আলাদা—কখনও শিউলি ফুলের বোঁটার মতো রক্তাভ, আবার কখনও বা সোনালি হলুদ। প্রতিমার পেছনের চালচিত্রে আঁকা থাকত দশ মহাবিদ্যা এবং রাধা-কৃষ্ণের ছবি। বদলেছে বলতে গেলে শুধু দেবীর মন্দির। আগে যেখানে ছিল গোলপাতার ছাউনি ঘেরা মাটির আটচালা মন্দির, আজকে সেখানেই তৈরি হয়েছে ইট ও সিমেন্টের আটচালা মন্দির।
শুরু থেকেই এই পুজোর মধ্যে মিশে ছিল শাক্ত ও বৈষ্ণব—দুই ধারার রীতিনীতি। পুজো হয় বিদ্যাপতি রচিত ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ অনুসারে। তবে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজোর সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয়টা হলো অসুর পুজো। এই পুজোতে শুধুমাত্র দেবী দুর্গা নন, তার সাথেই পূজিত হন মহিষাসুরও। দেবীর পাশাপাশি, অসুরের জন্য আগে এই পুজোতে অষ্টমীর দিন মোষ ও পাঁঠা বলি হতো। এখন নিয়ম পরিবর্তন হয়ে এখন হয় শুধুমাত্র প্রতীকী মাষকলাই বলির প্রথা।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার আজ বহু শাখায় বিভক্ত। বড়িশা, নিমতা, বিরাটির বাড়িগুলোতে আলাদা আয়োজন হয় দুর্গাপুজোর। কোথাও নিরামিষ ভোগ, কোথাও আবার থাকে মাছ-মাংসের নৈবেদ্য। সন্ধিপুজোয় কোথাও ল্যাটা মাছ পোড়ানো হয়, আবার কোথাও প্রসাদে থাকে কেবল নিরামিষ পদ। তবে মূল অনুষ্ঠান—চণ্ডীপাঠ, হোম, কুমারী পূজা—সব জায়গাতেই একই আবহে পালিত হয়।
পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জমিদার প্রথার ইতিহাসও। মানসিংহের দেওয়া জমিদারিতে সাবর্ণরা হয়ে ওঠেন কলকাতার আদি অধীশ্বর। তাঁদের উৎসব হয়ে উঠত প্রজাদেরও উৎসব। সেই সময় কলকাতা শহরে ব্রিটিশ বাবুয়ানির ছাপ পড়েনি। দুর্গোৎসব মানেই ছিল জমিদার আর সাধারণ মানুষের মিলিত আনন্দ।
আজও বেহালার বড়িশার আটচালা মন্দিরে দাঁড়িয়ে থাকে সেই প্রাচীন স্তম্ভ। সময় পাল্টেছে, মাটির মন্দিরে আর গোলপাতার ছাউনি নেই, জায়গা নিয়েছে ইট-সিমেন্টের গঠন। তবু চার শতকের পুরোনো ঐতিহ্য আজও টিকে আছে। এই দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, ইতিহাসেরও এক জীবন্ত দলিল। কলকাতার আদি দুর্গোৎসব এখনও মনে করিয়ে দেয়—ঔপনিবেশিক বাবু-সাহেবদের কলকাতার অনেক আগে থেকেই বাংলার এই মাটিতে দুর্গাপুজো ছিল জমিদার আর প্রজার মিলিত উৎসব, স্বাধীনতার সুবাসে ভরা এক আদি পরম্পরা।
Discussion about this post