খরুণ গ্রামের রায় বাড়ির দুর্গাপুজো বীরভূমের ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। প্রায় ৩৭৪ বছরের পুরনো এই পুজো গ্রামবাসীর মধ্যে ধর্মীয় ভক্তি, ঐক্য এবং সংস্কৃতির ধারক। তারাপীঠ সংলগ্ন খরুণ গ্রাম, যা বর্ধিষ্ণু গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এখানে পাঁচটি দুর্গাপুজোর মধ্যে রায় বাড়ির পুজো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুজোর শুরু হয় রায় বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপ থেকে, আর এই পুজোকে কেন্দ্র করেই এলাকার অন্যান্য বাড়ির উৎসব শুরু হয়। মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা লগ্নে পটের প্রতিমাকে দিঘিতে নিরঞ্জন দিয়ে পুনরায় আহ্বান জানানো হয় এবং মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদে ঘট ভরে পুজোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
গ্রামে পুজোর সূচনা হয়েছিল এক অভিনব কারণে। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে গ্রামে মৃৎশিল্পী ছিল না বললেই চলে। ফলে পটে দুর্গার প্রতিমা তৈরি করে পুজো শুরু হয়। পরে গ্রামে কয়েক ঘর ব্রাহ্মণের বসবাস শুরু হলে তৎকালীন জমিদার রামনিধি ও রামকানাই রায় দুই ভাই মিলে প্রতিমা গড়ে পুজোর আয়োজন করেন। বর্তমানে পটশিল্প প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় শোলার তৈরি প্রতিমায় পুজো হয়ে আসছে। গ্রামে মালাকাররা শোলার সাজ তৈরি করে প্রতিমা গড়েন। এখানে দুর্গার পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী ছাড়া অন্য কোনো দেবতা থাকে না। পুজোর দিনগুলিতে গ্রামের মানুষ ও শরিক পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে মায়ের আরাধনায় অংশ নেন।
রায় পরিবারের শরিক পরিবার বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে যৌথভাবে প্রায় ৬৫টি পরিবার এই পুজোর আয়োজন করে। সপ্তমীর দিন শোলার দুর্গা মন্দিরে আনা হয়, বরণ এবং সিঁদুর খেলায় অংশগ্রহণ করেন গ্রামের নারীরা। অষ্টমীতে ফলপ্রসাদ এবং নবমীতে অন্নপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। নবমীর দিন বলির আচার পালিত হয় এবং মানত অনুযায়ী পাঁঠা বলিও দেওয়া হয়। দশমীতে নবপত্রিকা বিসর্জন হলেও প্রতিমাকে রেখে দেওয়া হয় এবং বছরভর নিয়মিত পুজো চলে। পরবর্তী মহালয়ায় পুনরায় প্রতিমা নিরঞ্জন করে নতুন করে পুজোর সূচনা হয়।
এই পুজো শুধু ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, গ্রামীণ ঐক্য এবং সংস্কৃতির এক মহিমান্বিত উৎসব। এখানে জমিদার আমলের ঐতিহ্য, শোলার শিল্প, পটচিত্রের ইতিহাস এবং গ্রামীণ সহযোগিতার মেলবন্ধন দেখা যায়। মহালয়ায় প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই পুজো গ্রামবাসীর কাছে বিশেষ এক আবেগ। আজও রায় বাড়ির পুজো ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে। যেখানে ধর্মীয় আচার, লোকসংস্কৃতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের সুতো একসূত্রে গাঁথা। এটি কেবল একটি পুজো নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐক্যের জীবন্ত প্রতীক।
চিত্র ঋণ – প্রশান্ত কুমার দত্ত
Discussion about this post