আমাদের বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার ও সাহিত্য যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই সমৃদ্ধ তার প্রবাদ আর প্রবচনের জগৎ। প্রবাদ কোনো ভাষার অন্যতম এক সম্পদ, যা যুগ যুগ ধরে লোকমুখে বা সাহিত্যে প্রচলিত হয়ে আসছে। এমন একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো “ধুন্ধুমার কাণ্ড”। এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রচণ্ড কোলাহল, তুমুল কাণ্ড বা ভীষণ গোলমাল। কিন্তু এই প্রবাদটির উৎপত্তি কোথা থেকে, তা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে পুরাণের গভীরে, রাজা কুবলাশ্ব ও দানব ধুন্ধুর উপাখ্যানে।
ভাগবত পুরাণে অযোধ্যার ইক্ষ্বাকুবংশীয় (সূর্যবংশ) রাজা বৃহদশ্বের কাহিনি রয়েছে। রাজা বৃহদশ্ব ঠিক করেন, পুত্র কুবলাশ্বকে রাজ্যভার দিয়ে তিনি বানপ্রস্থে যাবেন। কিন্তু মহর্ষি উতঙ্ক তাকে এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন। এর কারণ জানতে চাইলে মহর্ষি জানান, তার আশ্রমের কাছেই রয়েছে উজ্জ্বালক নামের এক বালু-সমুদ্র। সেই বালু-সমুদ্রের নিচে বাস করে মধু দানবের পুত্র ধুন্ধু। ব্রহ্মার বরে ধুন্ধু দেব, দানব, যক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ, রাক্ষস—সবার অবধ্য। তাই সে কাউকে ভয় পায় না এবং সকলের ক্ষতি করতে থাকে।
ধুন্ধুর নিঃশ্বাসের ক্ষমতা ছিল ভয়ঙ্কর। প্রতি বছর একবার সে নিঃশ্বাস ফেলত, যার প্রবল বেগে সমুদ্রের বালু ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে উপরে উঠে আসত এবং সূর্যের আলোকে ঢেকে দিত। মনে হতো যেন অকালে সূর্য অস্ত গেছে। একই সঙ্গে পৃথিবীতে ভূমিকম্পের মতো প্রবল কম্পন শুরু হতো। এই ঘটনা এক-দু’ঘণ্টা নয়, টানা সাত দিন সাত রাত ধরে চলত। এর ফলে সূর্যের আলো না-পেয়ে গাছপালা সব শুকিয়ে যেত, ফসল ও ফলফুলের ফলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
মহর্ষি উতঙ্কের কাছে এই ভয়ঙ্কর কাহিনি শুনে রাজা বৃহদশ্ব তার পুত্র কুবলাশ্বকে আদেশ দিলেন ধুন্ধুকে দমন করে আশ্রমের অধিবাসীদের শান্তি ফিরিয়ে আনতে। মহর্ষি উতঙ্কের কঠোর তপস্যায় খুশি হয়ে বিষ্ণু তাকে বর দিয়েছিলেন যে, তার যোগবলের মাধ্যমে রাজা কুবলাশ্ব ধুন্ধুকে বধ করতে পারবেন। উতঙ্কের অনুরোধে কুবলাশ্বের দেহে প্রবেশ করলেন বিষ্ণু।
রাজা কুবলাশ্ব একুশ হাজার পুত্র ও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে অগ্রসর হলেন ধুন্ধুকে বিনাশ করতে। এক সপ্তাহ ধরে বালুর সমুদ্র খনন করার পর দেখা গেল ধুন্ধু ঘুমাচ্ছে। কিন্তু বালু খননের তুমুল হট্টগোলে সে জেগে উঠল। তার মুখ থেকে আগুনের হল্কা বের হতে শুরু করল এবং কুবলাশ্বের পুত্ররা সেই আগুনে ভস্ম হয়ে গেল। কিন্তু বিষ্ণুর শক্তিপ্রভাবে কুবলাশ্ব তার যোগশক্তি প্রয়োগ করে ধুন্ধুর মুখাগ্নি নিভিয়ে দিলেন। এরপর ব্রহ্মাস্ত্রের সাহায্যে তিনি ধুন্ধুকে বধ করলেন।
ধুন্ধুকে তুমুল উত্তেজনা, শোরগোল এবং প্রচণ্ড সংঘর্ষের মাধ্যমে বধ করার পর রাজা কুবলাশ্ব “ধুন্ধুমার” অর্থাৎ “ধুন্ধুর বিনাশকারী” উপাধিতে পরিচিত হলেন। এই ভয়ানক উত্তেজনা ও শোরগোলের মাধ্যমে ধুন্ধুকে হত্যার ঘটনাকে স্মরণ করেই “ধুন্ধুমার কাণ্ড” প্রবাদটি আজও আমাদের ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
প্রবাদ পুরুষ ধুন্ধুমার হলেন সেই রাজা কুবলাশ্ব, যিনি এক প্রবল পরাক্রমশালী দানবকে বিনাশ করতে তুমুল কোলাহল, ভয়ানক কাণ্ড ও বিপুল আয়োজন করেছিলেন। তাই যখনই কোনো বিশৃঙ্খল বা বড় ধরনের গোলমালের ঘটনা ঘটে, তখনই আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠি, “এ তো ধুন্ধুমার কাণ্ড!” এই প্রবাদটি বাংলা ভাষার এক অসাধারণ সম্পদ, যা আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে পুরাণের যোগসূত্র স্থাপন করে।
Discussion about this post