ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক রায় অনুযায়ী দিল্লি এন সি আর এলাকার সমস্ত পথকুকুরকে রাস্তাঘাট থেকে সরিয়ে স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হবে। আদালতের এই নির্দেশ ঘিরে প্রাণীপ্রেমী ও পশুকল্যাণ সংস্থাগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বহু বিশেষজ্ঞ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই সিদ্ধান্তকে অবাস্তব ও অমানবিক বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটি ওঠে মূলত দিল্লিতে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কুকুর-আক্রমণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২,০০০ কুকুর কামড়ের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। এর মধ্যে একাধিক শিশু মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে জলাতঙ্কে মৃত্যুর ৩৬ শতাংশই ঘটে ভারতে, আর এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই ১৫ বছরের নিচের শিশু। আদালতের ভাষ্যে বলা হয়েছে—
“শিশু ও নবজাতকেরা কোনোভাবেই জলাতঙ্কের শিকার হবে না। এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে তারা নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে।”
এই রায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই প্রাণী অধিকার কর্মীরা প্রতিবাদে সরব হন। নতুন দিল্লির সংস্থা রেড প’জ রেসকিউ এক বিবৃতিতে জানায়— “এটা আসলে পথকুকুরদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের সমান। গণ-উচ্ছেদ কোনো সমাধান নয়।” প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও প্রাণী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম মুখ মেনকা গান্ধীও একই সুরে সমালোচনা করেন। তাঁর কথায়, “হয়তো আদালত রাগের বশেই এই রায় দিয়েছেন। বাস্তবে এটা কার্যকর করা সম্ভব নয়।”
দিল্লির এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে রবিবার, ১৭ আগস্ট বিকেল পাঁচটায় আশ্রয় (হোম অ্যান্ড হসপিটাল ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন)-এর উদ্যোগে একটি পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন বহু পশুপ্রেমী। ডেইলি নিউজ রিলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় আন্দোলনের অন্যতম মুখ গৌতম সরকার এই প্রসঙ্গে বলেন—
“ভারতে পশুপাখিদের উপর আক্রমণ এই প্রথম নয়। আগে কোথাও পথকুকুর, কোথাও পায়রা, আবার ঝাড়গ্রামে হাতিদের উপরেও এমন আক্রমণ হয়েছে। তাই দিল্লির ঘটনাও নতুন নয়। কিন্তু এই রায়ে এত সংখ্যক কুকুরকে সরিয়ে নেওয়া কতটা সম্ভব, সেটাই বড় প্রশ্ন। কারণ এত কুকুরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রচুর খরচ প্রয়োজন, অথচ অনেক কম খরচে রাস্তায় রেখেই টিকাকরণ ও বন্ধ্যাত্বকরণ করা যায়। তাতেই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, কুকুরদেরও কষ্ট পেতে হবে না।”
গৌতমবাবু আরও যুক্তি দেন—
“কুকুর একেবারেই অপ্রয়োজনীয় নয়। তারা বিনা পারিশ্রমিকে পাহারাদার। রাতে অচেনা কাউকে দেখলে চিৎকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ফলে অপরাধ দমন হয়। কুকুর না থাকলে চুরি-ডাকাতি বাড়বে। আবার কুকুর ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করে। যদি কুকুর সরিয়ে দেওয়া হয়, ইঁদুরের উপদ্রব বাড়বে, প্লেগের মতো মহামারীর ঝুঁকিও তৈরি হবে। তাই এই রায় কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।”
দিল্লির এই রায়ের পর অনেকেই এই রায়কে সমর্থনও জানিয়েছেন, যেখানে তারা যুক্তি রাখছেন, কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্কের সম্ভাবনা বাড়ে এবং গভীর রাত্রে হাইওয়েতে কুকুর চলে আসার কারণে পথ দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এই যুক্তির প্রসঙ্গে গৌতম বাবু বলেন, “শুধু কুকুর নয়, বিড়াল, শেয়াল, খেঁকশেয়ালসহ আরও অনেক প্রাণীর কামড়ে জলাতঙ্ক হতে পারে। তাহলে কি তাদের সবাইকে বন্দী করা হবে? এটা কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নয়। আর, হাইওয়ের দুর্ঘটনার জন্য শুধু কুকুরকে দোষ দেওয়া চলে না। অনেক সময় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, বা ওভারস্পিডই দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে ওঠে। তাহলে কি ভারতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হবে? পাশাপাশি, ভারতে প্রতিদিন যতজন মানুষ কুকুরের কামড়ে প্রাণ হারান, তার থেকেও অনেক বেশি মানুষ প্রাণ হারান সাপের কামড়ে। তাহলে কি এবার সাপের কামড়ে মৃত্যু কমাতে দেশের সব বিষধর সাপকেই বন্দী করা হবে?”
এই কারণেই গৌতম সরকারের অভিযোগ, মূলত সরকারের ব্যর্থতাই এই সমস্যার কারণ। তিনি বলেন—“প্রতিটি পৌরসভা বা পঞ্চায়েতে ‘প্রাণী মিত্র’ নামের একটি পদ রয়েছে। তাদের দায়িত্ব টিকাকরণ ও বন্ধ্যাত্বকরণ। কিন্তু বাস্তবে কোনো কর্মী নেই, কাজ হয়নি। ফলে সংখ্যা বেড়েছে। এখন মানুষ প্রশ্ন করছে, আর তার জবাব দিতে না পেরে সরকার এই অবলা প্রাণীদের নিশানা করছে।”
পরিশেষে তিনি বলছেন, কুকুর মানুষকে শত্রু মনে করে না, বরং সঙ্গী হিসেবে বাঁচে। সামান্য খাবার ও ভালোবাসা দিলেই তারা মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠে। দিল্লির আদালতের রায়ে পথকুকুর সম্পূর্ণ উধাও হবে— এমন ধারণা অবাস্তব। কারণ এক জায়গার কুকুর সরালে অন্য জায়গার কুকুর এসে দখল নেবে, আর না হলে অন্য প্রাণী চলে আসবে। তাই গণ-উচ্ছেদের বদলে টিকাকরণ ও বন্ধ্যাত্বকরণই হতে পারে সমস্যার স্থায়ী সমাধান।
Discussion about this post