একটি উজ্জ্বল বলের মতো মাথা, গায়ে চকচকে গোলাপি বসন— লিকলিকে দেহধারী প্রাণীটির নাম ‘অ্যাং’। সে এসেছিল সুদূর গ্রহ ‘ক্রেনিয়াস’ থেকে—সেই বহির্বিশ্বের অতিথি হয়ে, যুদ্ধ নয়, বরং ভালোবাসার বার্তা নিয়ে। এই যে ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বের কাহিনি—এটি কোনো দুঃসাহসিক অভিযান নয়, এটি ছিল এক মনস্বী চিত্রনাট্যকারের স্বপ্নসন্ধানী কলমের নির্মিতি। আপামর বাঙালি পাঠকের সঙ্গে এই ভিনগ্রহের প্রাণীটির পরিচয় করিয়ে দেওয়া এই কাহিনীটি ছিল —‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’। আর এই কাহিনীর পিছনের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলার চলচ্চিত্রভুবনের ধ্রুবতারা, সত্যজিৎ রায়।
এই বন্ধুত্বের গল্পকেই ছবিতে রূপ দিতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। তৈরি করতে চেয়েছিলেন ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রথম এক্সপেরিমেন্টাল কল্পবিজ্ঞানের ছবি যেখানে মিলেমিশে এক হয়ে যেত এই গ্রহের মানুষ আর ভিনগ্রহের এক আগন্তুক। ছবির নামও ভেবে ফেলেছিলেন সত্যজিৎ — দ্যা এলিয়েন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত একাধিক সমস্যার কারণে এই ছবি তৈরি করে উঠতে পারেননি সত্যজিৎ রায়। কল্পবিজ্ঞান ও মানবিক অনুভবের এমন সংমিশ্রণ সেই সময়ে অনাবিষ্কৃত ছিল, যা সত্যজিৎ রচনা করেছিলেন ভবিষ্যতের ভাষায়। কিন্তু সেই ছবির ক্যানভাসে আঁকা হল না কোনো দৃশ্য। রঙের কুয়াশায় হারিয়ে গেল এক মহাকাব্যিক চিন্তা।
তবে, শুধুমাত্র ছবি না করতে পারাটাই সত্যজিতের একমাত্র দুঃখ ছিলনা। ১৯৮২ সালে তার এই না হওয়া ছবির স্ক্রিপ্টের মধ্যেই কিছুটা পরিবর্তন করে হলিউডে স্টিভেন স্পিলবার্গ তৈরি করেছিলেন ইটি – দ্যা এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল। এই ছবিটি আসার পর সত্যজিৎ অভিমানী হয়ে এই ছবির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সত্যজিৎ নিজেই, তবে হলিউডের বিরুদ্ধে যাওয়া কি আর অতটাই সোজা!
সত্যজিতের স্বপ্নের দ্যা এলিয়েন ছবিটির বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। সেবছর আর্থার সি. ক্লার্কের সঙ্গে আলাপে, হঠাৎ সত্যজিতের কল্পনার সেই বিচিত্র রূপকল্পে ক্লার্ক মুগ্ধ হলেন। ছবিটির জন্য উৎসাহিত করলেন সত্যজিৎকে এবং নিজেই মাইক উইলসনকে ভারতে পাঠালেন। সত্যজিৎ নিজের হাতে গড়ে তুললেন একটি চিত্রনাট্য, যার সংবেদনশীলতা, মেধা ও মৌলিকত্ব সেই সময়ের হলিউডকেও অবাক করে দেয়।
‘দ্য এলিয়েন’ প্রকল্পে জড়িয়ে পড়লেন পিটার সেলার্স, কলম্বিয়া পিকচার্স, এমনকি মার্লন ব্র্যান্ডোও। একজন হলিউড ক্যামেরাম্যান, হাস্কেল ওয়েক্সলার, তো বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেইসময় ১০ হাজার ডলারের চুক্তি—এক অনন্য স্বীকৃতি। কিন্তু এই সুবর্ণ সম্ভাবনার সমস্ত দ্বার আটকে দিলেন আর্থার সি ক্লার্কের এজেন্ট মাইক উইলসন। তিনি সত্যজিতের এই ছবিতে প্রযোজক হিসাবে থাকতে চান। কিন্তু, সেই আবদার মেনে নেয়নি কলম্বিয়া পিকচার্স। তারা জানায়, মাইক উইলসনকে পুরো ছবি থেকে সরিয়ে দিতে হবে, বরং তারাই এই ছবির প্রযোজনা করবে। ফলে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়। যদিও পরে জানা যায়, কলম্বিয়া পিকচার্স এই সমস্যা তৈরি করেছিল মাইকের কথাতেই। মাইক উইলসনের অদৃশ্য চক্রান্তের জালে, পিটার সেলার্সের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, কলম্বিয়া পিকচার্সের পিছু হটা—সব মিলিয়ে, এক অনিবার্য পরাজয় ডেকে আনে। সত্যজিৎ ছিলেন শিল্পী, চতুর আইনজ্ঞ নন। ফলে স্বপ্নের জাহাজ ডুবল জলদস্যুর ছলনায়।
এর পরের ইতিহাস যেন আরও বিষণ্ণ। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেল স্পিলবার্গের ‘Close Encounters of the Third Kind’, ১৯৮২ সালে ‘E.T.: The Extra-Terrestrial’। আর তখনই হৃদয়ভঙ্গ হলো সত্যজিতের। এত মিল! চরিত্রের ধরন, কাহিনির কাঠামো, অনুভূতির সূক্ষ্ম রেখাচিত্র—সবই যেন এক ছায়াপাত ঘটায় সত্যজিতের সেই চিত্রনাট্যের।
সত্যজিৎ নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—“আমার ‘দ্য এলিয়েন’ ছাড়া এই ছবি তৈরি হতেই পারত না।” আর্থার সি. ক্লার্কও সম্মত হন সেই বক্তব্যে। ‘লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস’-এর পাতায় প্রতিবাদ উঠে এল, কিন্তু হলিউড পুরো অভিযোগ উড়িয়ে দিলো। স্পিলবার্গ দাবি করেন, সে সময় তিনি স্কুলপড়ুয়া। অথচ বাস্তবে তিনি তখন হলিউডে ইন্টার্ন। সত্যজিৎ বলেছিলেন, আর্থার সি ক্লার্কের জন্য চিত্রনাট্য তৈরি করার কারণে, সেই চিত্রনাট্যের অনেক কপি পুরো হলিউডে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে বিষয়টা লিক হয়ে যাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। সবচেয়ে দুঃখজনক, পরে যখন সত্যজিৎ আবার ছবিটি করতে চাইলেন, তখন সময়, প্রেক্ষাপট, বিতর্ক—সব মিলিয়ে তা আর সম্ভব হল না। একটি রেডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন—এখন যদি তিনি ছবি বানান, বলা হবে, তিনি স্পিলবার্গকে অনুকরণ করছেন!
আজ সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর ৩৩ বছর পরেও, এই ঘটনা হলিউডের চৌর্যবৃত্তির কথা বারবার ঘোষণা করে। ‘দ্য এলিয়েন’—যদি তৈরি হত, তা হতে পারত ভারতীয় কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্রের এক দীপ্ত মহাগাথা। কিন্তু তা হয়নি। শুধুই কাগজে আঁকা রঙিন রূপরেখা হয়ে রয়ে গেল।
Discussion about this post