পালে পালে কালো মানুষদের সমুদ্র পেরিয়ে আনা হচ্ছে আমেরিকা, তারা হবে সাদা মানুষের দাস। পেরিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। রিপাবলিকান নেতা আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা সরিয়ে দিলেও, তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। তারও প্রায় একশ বছর বাদে মার্টিন লুথার কিং ভাষণ দিচ্ছেন “আই হ্যাভ আ ড্রিম” শিরোনামে আর খুন হচ্ছেন। খুন হচ্ছেন হাজার হাজার আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষ, তাঁদের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে উল্লাস করা হচ্ছে। এসবের মধ্যেই জন্ম নিলো একটি কালো মেয়ে। যার সুরের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে থাকলো সারা বিশ্ব। প্রায় ৯০ বছর। তারপর মেয়েটি বিদায় নিলো।
ঝাঁকড়া চুলের সেই মেয়েটির নাম ফ্ল্যাক। আফ্রিকান-আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী, যিনি মূলত সোল, জ্যাজ এবং আরঅ্যান্ডবি ঘরানার গানের জন্য বিখ্যাত। ১৯৩৭ সালে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগী। পিয়ানোতেও দক্ষতা অর্জন করেন। ক্লাসিক্যাল মিউজিকে পারদর্শী ফ্ল্যাক খুব দ্রুতই নিজের প্রতিভার স্বীকৃতি পান এবং ধীরে ধীরে পপ ও সোল গানের জগতে প্রবেশ করেন। তাঁর গান ভালোবাসা, মানবতা ও সংহতির শক্তি দেখিয়েছে, যা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে সঙ্গীতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের বার্তা দেওয়া সম্ভব।
রবার্টা এমন এক সময়ে গানের জগতে প্রবেশ করেছিলেন, যখন সাদা ও কালো চামড়ার শিল্পীদের মধ্যে ভেদাভেদ স্পষ্ট ছিল। সেখানে রবার্টা একে তো মেয়ে, তারপর আবার কালো। অনেক কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পী সেই সময় শুধুমাত্র বর্ণের কারণে স্বীকৃতিই পেতেন না। কিন্তু ফ্ল্যাকের মসৃণ, সংবেদনশীল ও জ্যাজ-সুলভ কণ্ঠ মূলধারার সঙ্গীতজগতে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর গান “Compared to What” সরাসরি বর্ণবৈষম্য, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। এই গানটি ১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পরই আমেরিকায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর অপর একটি গান, “Tryin’ Times”, ১৯৭০-এর দশকের বর্ণবাদ, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবিচারের চিত্র তুলে ধরে। তাঁর “The First Time Ever I Saw Your Face” গানটি জিতে নেয় গ্র্যামি। “Killing Me Softly” শিরোনামের গানটিও সাফল্য অর্জন করে, যা ১৯৭৩ সালে আবারও তাঁকে গ্র্যামি এনে দেয়।
রবার্টা নানা সময় গান গেয়েছেন ডনি হ্যাথওয়ের সঙ্গে, যা তাঁদের যুগলবন্দিকে কালজয়ী করে তুলেছে। ১৯৭৯ সালে ডনির মৃত্যুর পর ফ্ল্যাক মানসিক ধাক্কা খান। তাঁর সঙ্গীতজীবনেও এর প্রভাব পরে। পরবর্তীকালে, তাঁর স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা যায়। ২০১৮ সালে স্ট্রোকের পর তাঁর গান গাওয়ার ক্ষমতা অনেকটা হ্রাস পায়। তিনি আক্রান্ত ছিলেন বিরল এক দুরারোগ্য ব্যাধি এ এল এস-এ। যা তাঁর নার্ভ এবং মাসলকে ধীরে ধীরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তুলছিল। তাই শেষ বয়সে তিনি গান গাইতে পারতেন না। ২৪ ফেব্রুয়ারী ৮৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। রেখে গেলেন তাঁর গানগুলি।
Discussion about this post