দুই যমজ বোন। তাদের হাতে আদর করে কয়েকটা মিষ্টি তুলে দিল অচেনা দুটো লোক। দুই বোনের মধ্যে একজন সেই মিষ্টি মুখে দিতেই ছটফট করে উঠল। নীল হয়ে এল ঠোঁট। নিস্তেজ হয়ে এল ছোট ছোট হাত। পাশে আরেকজন তখন বিভ্রান্ত, অবাক, ভীত। বাকি গল্পটা আর উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই শেষ হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট প্রাণটা। আর বরাতজোরেই হয়ত বেঁচে গিয়েছিল চার বছরের ছোট্ট বিব্বি। বোন জোহরাকে শেষ দেখাটুকুও আর সে দেখতে পায়নি। সে এটাও বুঝতে পারেনি, বোন মারা যাওয়ার পিছনে হাত ছিল তার আপন বাবার। এই ছোট্ট বিব্বিই হলেন আমাদের অতি পরিচিত বেগম আখতার। যাঁর গলার সুরে ওলটপালট হয়ে যেতে পারে সমস্ত।
বোনের জীবন শেষ করতে পারলেও তাঁকে শেষ করা যায়নি। ১৯১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে তার জন্ম। সম্পত্তিজনিত কারণে দুই মেয়েকে নিয়ে মা মুস্তারি বেগম স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে গয়াতে তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই মৃত্যু হয় বোন জোহরার। ইতিমধ্যে উস্তাদ জামির খাঁ-র কাছে বিব্বি তালিম নেওয়া শুরু করেছে। তার গান রেকর্ড হয়, কিন্তু কেউ তা শোনেনি। কিন্তু এক পীরবাবা বলেছিলেন, ‘এক দিন এই মেয়ের সামনে সারা পৃথিবী মাথা নত করবে।‘ তিনি বিব্বিকে গানের খাতা খুলতে বলেন। চোখ বন্ধ করে হাত রাখেন খাতার একটি পাতায়। সে পাতাতেই ছিল ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো’ গানটি। যে গানটি রেকর্ড হয়ে বেরোনোর পরে বিব্বিকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
তারপর কলকাতায় আসা। উস্তাদ আতা মহম্মদ খানের কাছে তালিম। থিয়েটারে অভিনয় দক্ষতার পরিচয়। সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বম্বে থেকে ডাক। পাশাপাশি আসতে থাকে বিভিন্ন রাজপরিবারের সঙ্গীতের মেহফিলে গান গাইবার অনুরোধ। বম্বের জীবনযাত্রা তাঁর পছন্দ ছিল না। তাই ফিরে আসা লখনউতে। সেখানে তাঁর বাড়ি। গানের ভিতর ডুবে থাকা বিব্বির জীবনে এলেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ আব্বাসি। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন আখতারি বাঈ। কিন্তু বিয়ের শর্ত ছিল, তাঁকে ত্যাগ করতে হবে সঙ্গীত। জীবনের অর্থই বদলে গেল বিব্বির কাছে। জন্ম দিলেন মৃত সন্তান। চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন, এমন কিছু করতে, যাতে আখতারি ভাল থাকেন। ফলে আবার শুরু হল গান। ‘বেগম আখতার’ নামে প্রকাশিত হল দুটি গানের রেকর্ড। ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’ এবং ‘সঁইয়া ছোড় দে’।
উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের একটি মিশনারি স্কুলে অর্থ সাহায্য করতে এসেছিলেন গওহরজান। হঠাৎই তাঁর ওড়নায় টান। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখেন, ছোট্ট একটি মেয়ে। মেয়েটির কণ্ঠস্বরেই গওহরজান বুঝেছিলেন সে গান গায়। তাঁর কথাতেই ছোট্ট বিব্বি গেয়ে উঠেছিল একটি কলি। সেই শুনেই গওহরজান নিশ্চিত হয়েছিলেন যে এই মেয়ে এক দিন বড় শিল্পী হবে। তা সে হয়েছে। জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কোন কিছুই তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর কণ্ঠের মাদকতায় আজও আচ্ছন্ন আমরা। ‘জোছনা করেছে আড়ি‘ বা ‘কোয়েলিয়া গান থামা’ আজও নবীন।
Discussion about this post