একদিকে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ঘন জঙ্গল, অন্যদিকে পানিঝোড়া গ্রাম। আলিপুরদুয়ার শহর থেকে রাজাভাতখাওয়ার মাঝে প্রায় ১২ কিমি দূরত্বে অবস্থিত এই পানিঝোড়া গ্রাম। ছোট্ট এই গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৩২০ ৷ পরিবার মাত্র ৭২টি ৷ ছাত্রছাত্রী ৮০ জন। গ্রামের মধ্যেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যার পড়ুয়ার সংখ্যা ৪২ জন। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এই গ্রামের মানুষের রোজগার অনেকটাই নির্ভর করে জঙ্গল আর দিন-মজুরির উপর। অবাক হচ্ছেন, এই ফিরিস্তি হঠাত কেন? কারণ, এই অখ্যাত গ্রামটিই হল সারা বাংলার প্রথম ‘বইগ্রাম’।
বই ভালবেসে একটা গোটা গ্রাম। শুনতে কেমন অবাক লাগে না? অবাক করা ঠিকই, কিন্ত অবাস্তব নয়। ইতিমধ্যেই কেরলের পেরুকালেম এবং মহারাষ্ট্রের ভিলারে এমনই বইগ্রাম রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই পানিঝোড়াই প্রথম বইগ্রাম। ‘আপনকথা’ নামক একটি সংগঠন এবং আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন গ্রামটিকে বেছে নিয়েছে বইগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। এই অঞ্চলে সাত থেকে আটটি আদিবাসী জনজাতি, রাজবংশী এবং সাধারণ মানুষ থাকেন। অনেকেই ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’। করোনার পর চেষ্টার পরে ছাত্ররা আস্তে আস্তে স্কুলে ফিরছে, বইমুখী হয়েছে। বইগ্রামের উদ্দেশ্যই হবে পড়াশোনাকে এদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা।
বইগ্রামে তৈরি হয়েছে ১৫টি ছোট গ্রন্থাগার, ১টি সেন্ট্রাল লাইব্রেরি। প্রশাসনিক আধিকারিক, জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকরা উপস্থিত থেকে তদারকি করেছেন বইগ্রামের প্রস্তুতির। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি আগামী দিনে নিঃসন্দেহে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে এই গ্রামটি। যন্ত্রের এই যুগে বই প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, এই সময়েই পানিঝোড়া গ্রামের মানুষগুলির মধ্যে বইয়ের প্রতি গড়ে উঠেছে নিবিড় ভালোবাসা। গ্রন্থাগারের বইগুলির দেখভাল করছে পড়ুয়ারাই। গোটা গ্রামকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে বই ও সামাজিক বার্তামূলক চিত্রকলায়।
গ্রামের মানুষেরা খুশি এই অভিনব উদ্যোগে। নতুন প্রজন্মকে শিক্ষায় আলোকিত করতে গিয়ে শুধু নতুন প্রজন্ম নয়, সমস্ত বয়সের মানুষকেই বই সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেছে এই প্রকল্প। শিশুদের মোবাইল ফোন আর টেলিভিশনের জগৎ ছেড়ে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা। ফলে, গ্রামকে আরও সাজিয়ে তুলতে এগিয়ে এসেছেন তাঁরাও। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালকে রঙে, কথায়, কবিতায়, ছবিতে ভরিয়ে তুলছেন তাঁরা। এই প্রকল্প প্রধানত ‘পাইলট প্রকল্প’ হিসেবে প্রথমে ভাবা হলেও, এই উদ্যোগে পানিঝোড়া গ্রামের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন গ্রামের মানুষ।
Discussion about this post