রাজশাহী শহর। অগুনতি অচেনা মানুষের ভিড়। একটি লংমার্চে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সর্বস্তরের মানুষ আসছে। রাস্তায় রাস্তায় লাউড স্পিকারে ঘোষণা হচ্ছে লংমার্চের সময়। পথঘাট উৎসাহিত জনতায় লোকারণ্য। বিশাল মাদ্রাসা মাঠে ভীড় উপচে পড়ছে। অসংখ্য মানুষের সেই মিছিলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নব্বই বছরের এক বৃদ্ধ। চারিদিকে বিস্ময়, অবিশ্বাস আর আশঙ্কাঘন চোখকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সেই বৃদ্ধ লং মার্চে অংশ নিলেন। তাঁদের উদ্দ্যেশ্য ছিল প্রকৃতিকে বাঁচানো, বাংলাদেশের মাটি ও জলকে রক্ষা করা। সেই নবতিপর বৃদ্ধ হলেন রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
ফারাক্কা বাঁধকে ঘিরে ভারত এবং বাংলাদেশের সমস্যা অনেক যুগের। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য প্রথম ও প্রধান সমস্যা ফারাক্কা বাঁধ, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা ঠিক রাখা এবং ভাগীরথী ও গঙ্গা প্রবাহ যাতে জাহাজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধ নির্মাণকাজ। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। বাংলাদেশও আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু কাজ আটকানো যায়নি। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়।
এই বাঁধ তৈরির বিপক্ষেই মাওলানা ভাসানি শুরু করেছিলেন লংমার্চ। ১৯৭৬ সালে তিনি বলেন যে, “অভিন্ন নদীর পানি কোনো দেশ এককভাবে পেতে পারে না। গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সুতরাং এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা যাবে না। ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের পানি প্রবাহ রুদ্ধ করতে চায়।“ তাঁর আশঙ্কা ছিল এই বাঁধ চালু হলে বাংলাদেশের কৃষিকাজে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে, পরিবেশের ক্ষতি হবে, বন্যা এবং খরার পরিমাণ বাড়বে। তিনি সাধারণ মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শাশ্বত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।“
এই ফারাক্কা বাঁধের কারণে, বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে গাড়ি পর্যন্ত চলাচল চলতে পারে। ভারতেও কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফারাক্কা বাঁধ নানা ধরনের বিপদ ডেকে এনেছে। বিহারের গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্রতি বছরের ভয়াবহ বন্যার জন্য ফারাক্কাকেই দায়ী করা হচ্ছে। অথচ এইগুলি আশঙ্কা করেই সেদিন পঁচানব্বই বছরের বৃদ্ধ পথ হেঁটেছিলেন। নিজের প্রায় ভগ্ন শরীর নিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে, প্রতিবাদ করে মানুষকে সমবেত করতে ডাক দিয়েছিলেন। আর সেই বৃদ্ধের ডাকে সাড়াও দিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ।
Discussion about this post