ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস মানেই তার অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকে আজকের নগর কলকাতা। নানা কিছুর সাক্ষ্য, প্রমাণ ও ইতিহাস সবকিছুকে বুকে করে নিয়ে বেঁচে আছে আমার আপনার সকলের শহর। আর এই শহরের রাস্তাঘাট গুলো যেমন প্রেম, হিংসা, রাহাজানি এসব কিছুর সাক্ষী থেকেছে, তেমনি কত রোমহর্ষক ঘটনাও জড়িয়ে রয়েছে তাদের সঙ্গে। ‘স্ট্রিটস ইন মোশন’ বইটিতে শহুরে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রাস্তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্ররূপে উপস্থাপিত করেছেন লেখক। কলকাতার বেশিরভাগ রাস্তাঘাটের নামকরণ হয়েছে ব্রিটিশ শাসক নতুবা মহাপুরুষদের নামে। কিন্তু কলকাতার ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ পর্যন্ত যে রাস্তাটি, তার একসময় নাম ছিল ফ্যান্সি লেন। তবে এই ফ্যান্সি নামটা শুনতে যতটা শৌখিন লাগছে, এর পিছনের ইতিহাস ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর বা বলা ভালো রোমাঞ্চকর।
কলকাতার সব পুরনো রাস্তাঘাট গুলির মধ্যে ফ্যান্সি লেন নামের রাস্তাটি অন্যতম। আর এখানে ফ্যান্সি কথাটির অর্থ মোটেই শৌখিন নয়, বরং ‘ফাঁসি’ শব্দটি থেকে আগত একটি শব্দ। আজ্ঞে হ্যাঁ, সাহেবদের উচ্চারণে ফাঁসিটাই হয়ে গেছে ফ্যান্সি। আসলে গোড়ার দিকে কোম্পানির আমলে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ওপর যে অত্যাচার করত, তার বর্ণনার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। ইতিহাসের পাতায় তা আজও জীবন্ত। কথায় আছে, লঘু পাপে গুরুদণ্ড। সেই সময় ঠিক এই ব্যবস্থাটাই চালু হয়েছিল ব্রিটিশ রাজত্বের শুরুর দিকে।
সেই সময় তখন জব চার্ণকের রাজত্ব। খুব ছোটো অপরাধেও তাদের বিচার ছিল ফাঁসি। এবং তা কোনো অন্ধকার জেলখানার ভিতরে নয়, একেবারে দিনের আলোয় জনসমক্ষে। তখন এই রাস্তাটির ধারে ধারে বিশাল বড় বড় গাছ। আর এই গাছগুলোতেই তৈরি করে নেওয়া হত ফাঁসির মঞ্চ। রাস্তার ধার ঘেঁষে সার বেঁধে ঝুলে থাকত দেহ। এই যেমন ধরুন ১৮০০ সালে জনৈক ব্রজমোহনের ফাঁসি। তাঁর অপরাধ ছিল সেই আমলে পঁচিশ টাকা দামের একটি ঘড়ি চুরি করা। সেই সময় অনেকেই এই রাস্তার ধারে ভিড় করতেন ফাঁসি দেখার জন্য। ফেরার পথে কেউ হয়তো চোখ মুছতেন, আবার কেউ হয়তো ব্রিটিশদের ধন্যি ধন্যি করতেন। সেই ফাঁসি দেওয়া রাস্তাটির নামই পরবর্তীকালে হয়ে যায় ‘ফ্যান্সি লেন’।
তখন এই রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল একটি খাল বা সরু নদী যাকে বলা হত হেস্টিংস নদী। আজ সেই নদীর জায়গায় বিছিয়ে আছে স্ট্র্যান্ড রোড এবং কিরণশঙ্কর রায় রোড। ফ্যান্সি লেনে তৈরি হয়েছিল ফাঁসির মঞ্চও। আজ যেখানে ওল্ড কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিট, সেখানেই তৈরি হয়েছিল ফাঁসিকাঠ। এরপর ফাঁসির সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ না আছে সেই আমল আর না আছে সেই বিচার ব্যবস্থা। সবকিছুই বিলুপ্ত। কিন্তু তবু ইতিহাস বুকে করে আজও পড়ে রয়েছে সেই রাজপথ, সেইসব রোমাঞ্চকর ইতিহাসের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে।
Discussion about this post