ভারত বহুত্বের মিলনভূমি। ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্য বোধহয় ভারত ব্যতীত কোনও দেশ লালন করে না। তাই ক্যালেন্ডারের পাতায় উৎসবের শেষ থাকে না আগাগোড়াই। শীতের চাদর মোড়া ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ প্রথা মেনে সেজে ওঠে খ্রিস্টানদের পবিত্র ক্রিসমাসের আয়োজনে। ঈশ্বরের বরপুত্র যীশুর জন্মদিন মূলতঃ বড়দিন হলেও, দেশ ও রাজ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে তা সম্পৃক্ত সুনিবিড় ভাবেই। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও তাই গির্জাঘরগুলি সেজে ওঠে ক্রিসমাসের সুখসজ্জায়। অষ্টাদশ শতকের গোড়া অবধি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশের রাজধানী কলকাতা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পুনরায় উজ্জীবিত করে মেলে ধরে তার মনমোহিনী রূপ। সেজে ওঠে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল, ব্যান্ডেল চার্চ প্রভৃতি।
বিখ্যাত চার্চগুলির জৌলুসের পাশাপাশি উপাসনালয় হিসেবে ধর্মীয় ভাবনা ও উৎসবের আমেজকে স্বকীয়তায় মুড়ে শহর ও শহরতলির বিভিন্ন প্রান্তের গির্জাঘরগুলি সেজে ওঠে স্বমহিমায়। বাদ যায় না দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতার বেহালা অঞ্চলের গির্জা সেন্ট পিটার্স চার্চও। বেহালা চৌরাস্তা থেকে সখের বাজারের দিকে দু’পা এগোলেই একটা বিশাল এলাকা জুড়ে গির্জাঘর সেন্ট পিটার্স চার্চ। ২৯ জুন, ১৯৪৭ সালে ‘ডায়সেস অফ ক্যালকাটা’র সৌজন্যে নির্মিত হয় বেহালার বড়িষা অঞ্চলের এই ঐতিহ্যশালী গির্জাঘর। পূর্বে, গির্জা চত্বরে ছিল অক্সফোর্ড মিশন স্কুল। রয়েছে বিশাল মাঠ যা বিখ্যাত ছিল ‘ডগলাস গ্রাউন্ড’ হিসেবে। হয়তো অনেকেই জানেন, ‘প্রিন্স অফ ক্যালকাটা’ সৌরভ গাঙ্গুলির ঘরের মাঠ ছিল এই ডগলাস গ্রাউন্ডটি। বর্তমানে ক্রিকেট প্র্যাকটিস না হলেও মাঠ জুড়ে ইতিহাস রয়েছে ছড়িয়ে।
২০১৭ সালে পুরনো চার্চকে নতুন মোড়ক দেওয়া হয় সংস্কারের বিনিময়ে। আধুনিক নির্মাণ রীতি মেনে গতানুগতিক ‘গথিক’ আদল থেকে সরে গির্জার নতুন রূপ আধুনিক স্থাপত্য ও আধ্যাত্মিকতার মিশেল মনে হয় প্রথম দৃষ্টিপাতেই। বেহালা অঞ্চলের আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টান সদস্যের উপাসনাস্থল সেন্ট পিটার্স গির্জার পরিবেশ সবুজ ও শান্তিময়। প্রার্থনাস্থল ছিমছাম। ‘ইস্পাত ও কাচের’ অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলী প্রাকৃতিকভাবে আলো ও বাতাসের চলাচলের জন্য প্রশংসাযোগ্য সুযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। সেগুন কাঠের বার্নিশ করা বসার স্থানগুলোর কারুকাজ দেখার মতো। মূল বেদীও যথেষ্ট কারুকাজ করা। রয়েছে আড়ম্বরহীন অথচ সম্ভ্রম জাগানোর মতো পবিত্র ক্রস। মূর্তিহীন পবিত্রতা প্রার্থনাস্থলকে যেমন প্রদান করেছে গাম্ভীর্য, ঠিক তেমনই সঞ্চার করেছে ভক্তিরস।
সেন্ট পিটার্স চার্চ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসেন গির্জার বিনয়ী কর্মী রাজেশ অধিকারী। জানা গেল যে বর্তমানে গির্জার প্রধান উপাসক হলেন রেভারেন্ড শ্যামল পাল। ২৫ ডিসেম্বর চার্চ সংলগ্ন লনে ক্রিসমাস পালিত হয়। প্রার্থনা ও উপাসকের সম্বোধন ও শুভেচ্ছা সহ ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে চার্চ। ক্রিসমাস ছাড়াও দৈনিক উপাসনা বাদে প্রতি রবিবার ‘সানডে স্কুল’ আয়োজিত হয় গির্জায়। সেন্ট পিটার্স চার্চ ধর্মীয় বিষয়ক কাজ কর্মের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে সমান তালে। দুঃস্থ শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা ছাড়াও শিশু ও বড়দের জন্য চলে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ সংক্রান্ত কাজকর্ম। দৈনন্দিন জীবনের চাপ ও হতাশা কাটিয়ে সমাজ এবং দেশের প্রতি সহমর্মিতা ও কর্তব্যপরায়ণতার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে সেন্ট পিটার্স চার্চ। ধর্মের সঙ্গে সহিষ্ণুতা ও দেশপ্রেমের পাঠ দান করে চলেছে এই গির্জাটি নিরলসভাবে। বেহালার দ্রষ্টব্য স্থানগুলির তালিকা গড়লে তাই ইতিহাস বিজড়িত এই চার্চকে বাদ রাখা যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে না। বেহালা এলে আসতেই হবে একবার সেন্ট পিটার্স গির্জায়।
Discussion about this post