চলছে চৈত্রের শেষ সপ্তাহ। সুন্দরবনের গ্রামের পথে ঘুরে মাধুকরী জোগাড়ের পালা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সেই মাধুকরীতেই আসন্ন শিব গৌরীর বিবাহ সম্পন্ন হবে যে। শহর পরিস্থিতির দায়ে বৃত্ত ছাড়া হলেও গ্রাম বাংলার সাধারণ জীবনযাত্রায় এখনো রয়ে গিয়েছে কিছু রীতিনীতি, অনুষ্ঠান। আজও সেখানে পরম যত্নে পালিত হয় নীল ষষ্ঠী, গাজন, চড়ক উৎসব। তিনদিনের এই উৎসব যেমন শিকড়ের তেমনই নিখাদ আনন্দের আর অমলিন ভালোবাসারও। এ ক’দিন শিব গাজনের পালার ধ্বনিত সুরে মিলে মিশে থাকে সুন্দরী বনের আকাশ বাতাস, বোধ হয় বনবিবিরাও।
সুখ দুঃখে আটকে আটকে থাকা মানুষগুলো একত্রে শিব ঠাকুরের বিয়ের আয়োজন করতে নিমন্ত্রণ জানায় গাজন সন্ন্যাসীদের। অধিবাস, জল সন্ন্যাসের মধ্য দিয়ে কাটে প্রথম দিন। পরের দিন ভাঙর ভোলার (শিবের অপর নাম) বেদীতে নতুন মাটি লেপে পরম যত্নে তাঁকে স্নান করানো হয় ঘি, মধু, গঙ্গাজল সহযোগে। সারা সন্ধ্যে কাটে শিব ঠাকুরের গাজন গেয়ে, আসর মেতে থাকে আসন্ন বিয়ের উত্তেজনায়। ওই রাতেই নীল পুজোর মধ্যে দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন হয় শিব গৌরীর। এই গাজন আসলে সৃষ্টি শক্তিরই আরাধনা। সকল শক্তির উৎস সূর্য দেবতা ও প্রাণ সঞ্চারকারী ধরিত্রীর মিলন হলেই ফলবে ফসল, কচি সবুজ শীষে ভরে থাকবে মাঠ, এখানকার কৃষিনির্ভর ভক্তদের চাহিদা এতটুকুই।
প্রবল আকর্ষণীয় অংশ শেষ দিনের চড়ক পুজো। বিবাহ পরবর্তী দিনে কল্পনার বাসরে ফুলের সজ্জায় সেজে ওঠে চড়কের মাঠ, মাঠের গাছপালা, বাঁশের মাচা। এ কদিন গাজন সন্ন্যাসীরা এক বস্ত্রে থেকে ফলাহার করে শিবের যে উপাসনা করে তার সমাপ্তি হয় চৈত্র সংক্রান্তির এই চড়ক পুজো দিয়ে। ডালপালা, পাতা শূণ্য গাছের একটি কান্ডকে সেদিন অর্ধনারীশ্বর জ্ঞানে পুজো করা হয়। পুজো শেষে দুপুর ২:৩০ নাগাদ শুরু হয় ‘শিব পড়া’। মনস্কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু বাঁশের মাচা থেকে হাওয়ায় কারুকার্য দেখিয়ে নীচে পাতা জালে ঝাপ দিয়ে পড়ে সন্ন্যাসীসহ মানত রাখা সাধারণ মানুষ। এই দেখতে মাঠ তখন লোকারণ্য। প্রায় দু ঘন্টা ধরে প্রায় ত্রিশ জন শিবরূপী মানুষের দেখানো খেলায় মোহিত হয়ে থাকে জোড়া জোড়া চোখ। উপর থেকে ছড়িয়ে দেওয়া বাতাসা কুড়াতে গিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে শিশুদের শৈশব। শিব ঠাকুরের এতদিন ব্যাপী বিয়ের উৎসব স্বার্থকতা পায় বিকেলের পড়ন্ত আলোয় রাঙ্গা এই মানুষগুলোর অমলিন হাসিতে।
শিবের উদ্দেশ্যে অর্পিত পদ্মফুলের অবস্থানের স্খলন সত্যিই কোন অমোঘ নিয়মে হয় কিনা জানা নেই। তবে সেদিন ভক্তদের ‘জয় শিব’ ধ্বনির মধ্যে যে শক্তি থাকে তার রেশ নিশ্চিত রূপে থেকে যায় পরের বছরের চড়ক পুজো অবধি।
Discussion about this post