লোককাহিনী অনুযায়ী, শিব যোগীরাজ হলেও মূলত: ভিক্ষুক! রোজগারে অমনোযোগী, এ নিয়ে রাজার দুলালী গৌরির সাথে কলহ লেগেই থাকত। ক্ষোভে দুঃখে অভিমানী কাশীর ঘরের মেয়ে অন্নপূর্ণা বাপের বাড়ি চলে আসে। জয়া বিজয়ার পরামর্শে জগতের সকল অন্ন হরণ করে। শিব হা-অন্ন, হা-অন্ন করতে থাকে। অবশেষে লক্ষ্মীর পরামর্শে, কাশীতে এসে অন্নপূর্ণার হাত থেকে অন্ন খেয়ে শিব পরিতৃপ্ত হন। কদর করতে শেখেন অন্নের এবং অন্নপূর্ণার। সেই থেকে চৈত্র মাসে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে পুজো হয়ে থাকে অন্নপূর্ণার। দ্বিভূজা দেবীর বাঁ হাতে সোনার অন্নপাত্র এবং ডান হাতে দর্বী অর্থাৎ চামচ বা হাতা। মাথায় বিরাজিত অর্ধচন্দ্র। আগমবাগীশ তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে অন্নদাতা মাহাত্ম্যগাথা নিয়ে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচনা করেন অন্নদামঙ্গল কাব্য। এবার আসা যাক মধ্য কলকাতার সেন পরিবারের প্রাচীন অন্নপূর্ণা পুজোর কথায়।
সাল ১৮৯৮-৯৯, পুজোর শুরু করেন কলকাতার সেন পরিবারের পুত্রবধূ ভগবতী দেবী। ভগবতী দেবী একবার বারাণসীতে ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেখানে অন্নপূর্ণা মন্দির দর্শণ করে তারও ইচ্ছে হয় তার পরিবারেও এই পুজোর শুরু হোক। তাই বাড়ি ফিরেই তিনি এই পুজো শুরু করেন সেনভবনে। সেই থেকেই এই ঐতিহ্যপূর্ণ পুজো হয়ে আসছে সেন বাড়িতে। অন্নপূর্ণা পুজোর দিন একদিনেই সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী পুজো হয়। পরের দিন দশমী পুজো হয়ে বিসর্জন পর্ব শুরু হয়। পুজোর বিশেষত্ব হল এই পরিবারে ধুনো পোড়ানোর রীতি রয়েছে। রয়েছে ১০৮ প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের রীতি সহ আরও নানান রকমের নিয়ম। প্রথা অনুসারে, বিসর্জনের দিন মহাদেব ভক্তদের ভিক্ষা গ্রহণ করেন। পুজোর প্রতিষ্ঠিত ঘটে বিসর্জনের আগে মহাদেবকে সমস্ত ভক্তবৃন্দ ভিক্ষা দেন। এই পরিবারে দেবীকে অন্নভোগ নয় দেবীকে লুচি ভোগই দান করা হয়। লুচির সাথে থাকে পাঁচ রকমের ভাজা, পায়েস ও নানান রকমের মিষ্টান্ন ইত্যাদি।
সেন পরিবারের রীতি হল ব্রাহ্মণ পুরুষই ভোগ রান্না করবেন, তাই নিয়ম মেনেই ব্রাহ্মণ পুরুষ দিয়েই ভোগ রান্না করানো হয়।এই ভোগ নিবেদনের সময় পাঁচটি থালায় ২৮টি করে লুচি আর পাঁচ রকমের ভাজা দেওয়া হয়, এই পাঁচটি থালা দেবী অন্নপূর্ণা, মহাদেব, নন্দীমহারাজ, লক্ষ্মী ও নারায়ণের নামে উৎসর্গ করা হয়। দশমীর দিনও একই ভোগ নিবেদন করা হয়। পরিবারে কনকাঞ্জলি প্রথাও রয়েছে দশমীর দিন। এইভাবে নিষ্ঠার সাথে প্রায় ১২২বছর ধরে দেবীর আরাধনা হয়ে আসছে মধ্যকলকাতার সেনবাড়িতে। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের সামনেই সেনবাড়ি। তাই মায়ের দর্শন করতে ইচ্ছা হলে একবার যাওয়া যেতেই পারে।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – The Bong Chronicles
Discussion about this post