দোলের সঙ্গে রং আর নেশা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে। প্রেমের নেশা আর ভাঙের নেশা ছাড়া তো দোল জমেনা। নানান বিলিতি নেশা যতোই বাজার ছেয়ে ফেলুক না কেন দোলের দিন ভাঙের মতো করে বাঙালি আর কাউকেই কোনোদিন পাত্তা দেয়নি। ওই যে কথায় আছে ‘নেশা ভাং’। মোটকথা নেশার পাশে ভাঙের বেশ একটা পাকাপাকি জায়গা রয়েছে। তবে সম্ভবত দোলে ভাঙের চল এসেছে ভিনরাজ্যগুলির ‘হোলি’ থেকে। কারণ বাঙালির দোল মূলতঃ রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে। আর ভাং হল গিয়ে মহাদেবের আসল প্রসাদ।
উৎস যেখানেই হোক না কেন বাঙালি ভাং নামের এই দেশীয় পানীয়টিকে আপন করে নিয়েছিল। আগে তো বিজয়া দশমীতেও পাড়ায় পাড়ায় ছিলো সিদ্ধির সরবত তৈরীর রমরমা। ঠান্ডাই বা ভাঙের সরবত তৈরী করতে মূলত দুধের মধ্যে মেশানো হয় দই, সন্দেশ, ড্রাই ফ্রুটস,মৌরী, এলাচ, গোলাপের পাপড়ি নানাকিছুই। এরপর ‘ভাং-এর গুলি’ মিশিয়ে এই নিরীহ সরবতটিকে নেশা সরবত বানানো হয়। পাড়ায় ভাং বা সিদ্ধির সরবত বানানোর চল আজ আর তেমন নেই। কিন্তু দোলের দিনে আপনি চাইলে নিশ্চয়ই ভাঙের সরবত চাখতে পারবেন। শহর কলকাতার কিছু বিখ্যাত সরবত, লস্যির দোকানে দোলের দিন ভাঙের সরবতের কাটতি থাকে দেখার মতো।
উত্তর কলকাতার সরবতের সেরা ঠিকানা যে দোকানটি, তার নাম ‘শিবাশ্রম’। হেঁদুয়া থেকে হাতিবাগানের দিকে এগোলে ক্ষুদিরাম কলেজের উল্টো ফুটেই পড়ে ‘শিবাশ্রম’। প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো দোকান। এখানে নানান ফ্লেভারের, নানান রঙের লস্যি ও সরবত পাওয়া যায়। এই দোকানে দোল তো বটেই, সারাবছরই পাওয়া যায় ভাঙের সরবত। দোল, শিবরাত্রি, বিজয়া দশমীতে এই ছোট্ট দোকানের বাইরে পড়ে যায় লম্বা লাইন। বহরে এমন কিছু বড় দোকান না হলেও শুধু স্বাদের টানেই বহু টালিগঞ্জের তারকা এখানে এসেছেন।
দক্ষিণ কলকাতাতেও যে দোলে এই ভাঙের সরবতের সুলুক সন্ধান একেবারেই পাওয়া যায়না তা কিন্তু নয়। খোঁজ করে দেখলে সবজায়গাতেই এসব অমূল্য রতন মেলে। দক্ষিণ কলকাতায় ভাঙের অন্যতম সেরা ঠিকানা বালিগঞ্জ। বালিগঞ্জ পেট্রোল পাম্পের বাইরে একটি পানের দোকানে সারাবছর পান পাওয়া গেলেও দোলের দিনে এই দোকানে মেলে দোলের বিশেষ পানীয় ‘ভাং’। বিভিন্ন রকমের জিনিস দিয়ে পানওয়ালা এই সরবত বানান। যার স্বাদ নাকি একবার খেলে আর ভোলার নয়। ‘পান’ আর ‘পানীয়’ একইসাথে চেখে দেখতে চাইলে এ জায়গার জুড়ি মেলা ভার।
নিমতলার ভূতনাথ মন্দিরের পাশের লস্যি, ঠান্ডাইয়ের দোকানগুলির নামডাক উত্তর কলকাতায় বরাবরই রয়েছে। দোলে এখানে শুধু ভাং-এর সরবত নয়, ভাঙের লাড্ডুর জন্যও ভিড় করে অনেকেই। এই দোকানের বিশেষ জিনিসটিই এই ভাঙের লাড্ডু। স্টিলের গ্লাসে ভাঙের সরবত আর গঙ্গার ঘাটের হাওয়া, দোলে এর বেশি আর কী চাই? কলকাতার এই ‘গঙ্গাকিনারেওয়ালা’ ভাঙের সরবতের স্বাদ দোলের আনন্দ দ্বিগুণ করে দিতে পারে। দোলের সময় ভাং শুধু তো একটা নেশা নয়, ঐতিহ্যও বটে। কিন্তু নেশা যেমনই হোক, নেশার মাত্রই বিপজ্জনক। সুতরাং দোলে ভাং খেলেও সাবধানে খান। ভাঙের ‘হ্যাংওভার’ আবার সহজে কাটতেও চায়না, তখন মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করে। তাই পথেঘাটে বিপদ এড়াতে, হয় ভাঙের সরবত খেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান, নয়তো বাড়িতেই খান।
Discussion about this post