একটা পালিয়ে যাওয়ার গল্প শোনা যাক। গল্প হলেও কিন্তু সত্যি ছিল তা। সাল ১৯৪৪। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তখন বিদ্ধস্ত পৃথিবী। এসময় অক্ষশক্তি জার্মান তৈরী করেছিল একটি যুদ্ধবন্দী শিবির। নাম ছিল ‘স্টালাগ লাফট ৩’। হিটলার ও তার সৈন্যদের অত্যাচার তো সর্বজন বিদিত। শিবিরেও তাই রেহাই পেত না কেউ। চলতো চরম অত্যাচার। এই নৃশংসতা থেকে থেকে বাঁচার উপায় ছিল একটাই, পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু তা কি এতোই সহজ! চারিদিকে যে কড়া পাহারার রক্তচক্ষু। সেসব পেরিয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাও সম্ভব হয়েছিল একদিন। একজন দু’জন নয়। ৭৭ জন যুদ্ধবন্দী পালিয়েছিল একসাথে।
শিবির বানানো হয়েছিল এয়ারফোর্সের যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে। বন্দীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রজার জয়েস বুশেল। অক্সিলিয়ারি এয়ারফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার তিনি। ক্যাম্পের নৃশংসতা থেকে বাঁচতে তিনি পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সাধারণত ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ গোছের প্রবাদ সবার জন্য প্রযোজ্য হয়। সবাই আগে নিজের কথা ভাবে। বুশেল কিন্তু একেবারেই এমন ছিলেন না। তিনি ভেবেছিলেন নিজের জন্য এবং আরো ৭৬ জন বন্দীর জন্য। পালানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। করেছিলেন অদ্ভুত সব পরিকল্পনা। ইতিহাসে, একসাথে সব বন্দীর পালানোর ঘটনা বিরল। ‘দ্য গ্রেট এস্কেপ’ নামে তাই একে মনে রেখেছে পৃথিবী।
১৯৪৩ এর জানুয়ারি মাস। বুশেল পালানোর ফন্দি আঁটলেন। পরিকল্পনা করলেন সুড়ঙ্গ খোঁড়ার। যেহেতু তিনি একা নন, পালাবেন আরো কয়েকজনকে নিয়ে! তৈরী করলেন সাংকেতিক নাম। টম, ডিক ও হ্যারি অর্থাৎ আমি, সে এবং তারা। যেই কথা সেই কাজ। শুরু হল সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ। চারিদিকে কড়া পাহারা। প্রহরীর চোখ এড়িয়ে খুঁড়তে হবে সুড়ঙ্গ। ব্যবহার হল দৈনন্দিন আসবাবপত্রও। খাটের পাটাতন, ল্যাম্পশেড, বৈদ্যুতিক তার, চেয়ার এইসব। সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল মাটি থেকে তিরিশ ফুট নীচে। ১৯৪৪ এর মার্চে শেষ হয় কাজ। এক মুহুর্তের জন্যও অতো প্রহরীর কেউ বোঝেনি, তাদের চোখে ছুঁড়ে মারার জন্য ঠিক কত ধুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুড়ঙ্গ ভীষণ ছোটো। কোনোমতে শরীর ঢুকিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় তাতে। সাগান শহরের কাছের ওই শিবির চুপচাপ খুঁড়েছিল পালানোর রাস্তা।
সুড়ঙ্গ তৈরি হল। প্রহরী বা হিটলারের লোক জানতে পারলো না। পুরোদমে চললো সাতাত্তর জনের পালানোর মহড়া। শেষমেশ এলো বহু প্রতীক্ষিত অমাবস্যার রাত। চব্বিশে মার্চ ছিল দিনটা। বুশেলের পরামর্শ মতো একে একে পালানো শুরু করেন বন্দীরা। শেষরক্ষা হলো না। ৭৬ জন অতি সন্তর্পণে পালালেও ধরা পড়লো ৭৭ তম বন্দী। অতঃপর সাঁড়াশি অভিযান। হকচকিয়ে গেল তাবড় তাবড় রাজনীতিকরাও। এতদিন অনেক পালানোর গল্প শুনেছে তারা। কিন্তু একসাথে ৭৭ জন! এও সম্ভব! যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে এতো একতাবোধ! তাক লেগে গেল সবার। সেই সাঁড়াশি অভিযানে ধরা পড়েছিল ৭৩ জন। ৫০ জন পেয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। তাদের গুলি করে হত্যার বিধান দিয়েছিল হিটলার। প্রশ্ন উঠেছিল প্রহরা নিয়ে। বাহবা পেয়েছিল বুশেল। দুর্ভেদ্য ওই প্রহরা ভাঙার মুন্সিয়ানা দেখিয়ে। ইতিহাস অবাক হয়ে দেখেছিল ৭৭ জন সাহসী বন্দীকে। যারা একসাথে পালানোর স্পর্ধা দেখিয়েছিল ফ্যাসিস্ট নাৎসীদের।
Discussion about this post