আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। নাম শুনলেই চোখে ভাসে ডাবের জল আর নীল সমুদ্র। যাপনে লেগে থাকে ছুটির স্বাধীনতা। ১৮৫৮ সালের মার্চ মাসের পর থেকে স্বাধীনতার প্রাক মূহুর্ত! ছবিটা কিন্তু এমন ছিল না। দ্বীপ যাপন উপহার দিত নারকীয় বিভীষিকার। তখন ছিল ব্রিটিশ শাসন। দেশ স্বাধীন করবার চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন বহু তরুণ। অপরাধ লঘু হোক বা গুরু। শাস্তি হিসেবে মিলতো ফাঁসি নচেৎ দ্বীপান্তর। ফাঁসিকাঠে তবু জীবনের জ্বালা জুড়োতো। কিন্তু যারা টানতো যাবজ্জীবন জেলের ঘানি! জীবন তাদের দেখাতো নরকযন্ত্রণা কাকে বলে। অপরাধ যে তাদের দেশভক্তি! সেইসব যন্ত্রণার নির্মম ইতিহাস বহন করছে কুখ্যাত সেলুলার জেল। আমরা ক’জনই বা তা জানি!
৩৪৮ টি ছোটো বড়ো দ্বীপের সমন্বয়ে আন্দামান নিকোবর গঠিত। বিদ্রোহ যখন ব্রিটিশের রাতের ঘুম কেড়েছে। ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য আর অবশিষ্ট নেই টেলিগ্রাফ পোস্ট। তখন শাসকগোষ্ঠী শাস্তি হিসেবে বরাদ্দ করে যাবজ্জীবন। কালাপানি পার করে দুর্গম পরিবেশে ফেলে আসে বিপ্লবীদের। বরাদ্দ করে চাবুকের ঘা আর অভাবনীয় কায়িক শ্রম। ১৮৫৮ সালের মার্চ পরবর্তী সময়ে মূলত আন্দামানকে ব্যবহার করা হতো কয়েদী উপনিবেশ হিসেবে। ১৯০৬ এর দিকে জেল হিসেবে এর উদ্বোধন হয়। সংলগ্ন পাহাড়কে পূর্ব দিক থেকে কেটে, সমুদ্র থেকে ষাট ফুট উঁচুতে এই জেল গঠন করা হয়। প্রাথমিকভাবে সাত আটশো কয়েদী থাকার ব্যবস্থা করা হয়। খরচ হয়েছিল আনুমানিক দশ লক্ষ। ভবন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ডানদিকে থাকতো কয়েদীরা। বামদিকে অফিসাররা। জেলে ছিল না কোনো ডর্মেটরির ব্যবস্থা। প্রতিটি প্রকোষ্ঠই স্বতন্ত্র। তাই এর নাম হয়েছিল ‘সেলুলার জেল’। এক একটি প্রকোষ্ঠ ১৩.৫×৭ ফুট করে ছিল। বিপ্লবকে আটকে রাখতে লেগেছিল প্রায় ৩ কোটি ইট।
উনিশের শতক। কয়েদী উপনিবেশে প্রথম আসেন মহাবিদ্রোহের বীর সেনানীরা। তারপর ওয়াহাবী আন্দোলনের বন্দীরা। এবারে একে একে কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ও আলিপুর বোমা মামলার বিপ্লবীরা। বিশের দশকে স্বাধীনতার আওয়াজ তীব্রতর হয়ে ওঠে। কলকাতা হাইকোর্টে বিচার শুরু হয় তাদের। ছোটোখাটো অপরাধে জড়িতরাও দ্বীপান্তরিত হতে থাকে।বিশ শতকের বাঙালি তরুণদের মননে, তখন সেলুলার জেল মন্দির। যেখানে যে বাস করতো তাদের অনুপ্রেণাকারী বিপ্লবীরা! ভোগ করতো অশেষ শাস্তি! সে স্থান তো মন্দিরই। এহেন তরুণদের আচরন দেখে মনে হতো তারা শাস্তি ভোগ করতে নয়। তীর্থ করতে যাচ্ছে।
সম্পূর্ণ আলাদা ছিল প্রকোষ্ঠগুলো। কেউ কারো মুখ দেখতে পেত না। বাঙালির পাশের প্রকোষ্ঠে রাখা হতো মাদ্রাজী বা ওড়িশি। ভাষার তারতম্যে কথা বোঝা যেত না বিশেষ। কিন্তু বাঙালির বুদ্ধি! সেলের দেওয়ালে টোকা মেরে তারা প্রচলন করেছিল সরল টরেটক্কার ভাব বিনিময় মাধ্যম। উঁচু উঁচু প্রকোষ্ঠগুলোয় একটিই ঘুলঘুলি থাকতো। নোনা বাতাসের দেশ আন্দামান। প্রচুর মশা। আট-দশমাস বর্ষা। কয়েদীদের পরনে থাকতো পাটের কুটকুটে পোষাক। চামড়ায় ঘা হয়ে যেত। সারতো না সহজে। তার উপর চলতো অমানুষিক অত্যাচার। তেলের ঘানিতে বলদের বদলে জুড়ে দেওয়া হতো কয়েদীদের।খিদে ও তেষ্টায় ঘানি টানতে না পারলে ঘানির সাথেই টানা হয়ে যেত তারা। রক্তাক্ত হতো দেহ। মলমূত্র ত্যাগের জন্য ছিল একটিই হাঁড়ি। শৌচকর্মের প্রয়োজনে একটিন নোনাজল। পানের জন্য বরাদ্দ জল থেকে এক ফোঁটা বেশি মিলতো না। খাবারে মিশে থাকতো ইঁদুর বা আরশোলার মল।
বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীদের জঙ্গল পরিষ্কার, রাস্তা বানানোর জন্য বাইরে পাঠানো হতো। তারা ক্লান্ত শরীরে ফিরে ঐ খাবারটুকুও পেত না। অবশেষে খাদ্য বস্ত্রের জন্য অনশন করে বন্দীরা। অনশন বন্ধ করতে জোর করে নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ডাক্তার দিয়ে। মোহিত মৈত্র সহ কিছু কয়েদীর ফুসফুসে দুধ ঢুকে যায়। নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হলে তাদের অন্ত্যেষ্টি করা হয় হাঙরের মুখে ছেড়ে। অত্যাচারে অনেকে উন্মাদ হয়ে যায়। কারো পিঠে আছড়ে পড়ে পাঠান সেনার শতাধিক চাবুক। এহেন অমানুষিক অত্যাচার তাঁরা সহ্য করেন দেশভক্তির অপরাধে। পালানোর পথ নেই যে! মুক্তির আবেদনেও যে লেগে থাকবে অনুগ্রহের কালিমা। বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, শচীন সান্যাল, মদনমোহন ভৌমিকরা তাই সহ্য করতেন অমানুষিক অত্যাচার। এখন সেলুলার জেল পর্যটন কেন্দ্র। সেন্ট্রাল টাওয়ারের নীচে তাকালে দেখা যায় ৫৮৫ জন বীর সেবকের নাম। যাদের ৩৯৮ জনই বাঙালি।
Discussion about this post