মানচিত্র হোক বা কাঁটাতার। জিভ কোনোদিন পরোয়া করেনি তার। খাবারের স্বাদ, বহুবার মিলিয়ে দিয়েছে পৃথিবীকে। পরকে করেছে আপন। বিশ্বকে করেছে রসনাবন্দী। এমনই মিলনের গল্প শোনায়,’মানেকজি রুস্তমজি ধরমশালা ফর পার্সি ট্রাভেলার্স’। ধর্মশালাটি পার্সিদের। তবে হেঁসেলের স্বাদ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হননি কোনো বাঙালিই। একেবারে নিখাদ পার্সি খানায় জিভ জুড়োতে জুড়ি নেই এর। চাঁদনি চক মেট্রো থেকে নেমে কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ। পাওয়া যাবে ৯ নম্বর বো স্ট্রিট। এখানেই আছে প্রতীক্ষিত সেই তেতলা বাড়ি। খড়খড়ির জানালা তার। নকশা কাটা বারান্দায় রোদ আলপনা আঁকে রোজ। গেটে শ্বেতপাথরের ফলক। লেখা রয়েছে ধর্মশালার নাম।
তিনশো বছরের পুরোনো কলকাতা। যার নিজস্ব গল্পে ঢুকে পড়েছে বহু ভিনদেশী।তেমনই গল্প বুনেছেন পার্সিরাও। এনেছেন হেঁসেল ভর্তি লোভের পদ। উনিশ শতকের গোড়ায় কলকাতায় প্রায় লাখ খানেক পার্সি থাকতেন। ব্যবসা করতেন তাঁরা। এখন অবশ্য সংখ্যাটা মেরেকেটে চারশো। বেশিরভাগই একা থাকা বৃদ্ধ। তখন শহরে কাজে বা বেড়াতে আসতেন বহু পার্সি। তাঁদের জন্য একটি ধর্মশালা ছিল। দৈনিক থাকার জন্য ঘর ভাড়া ছিল আট আনা। তিনবেলা খেতে গেলে দু টাকা। পরে ১৯৩৬ সালে এই ধর্মশালাটি ভেঙে ফেলা হয়। গড়ে তোলা হয় আজকের ভোজনরসিকদের পীঠস্থান। মানেকজি রুস্তমজি ধর্মশালা। নতুন এই বাড়ির ঘরভাড়া পৌঁছেছিল বারো আনায়। খাওয়ার খরচও তিন টাকা ছুঁয়েছিল।
পার্সি ধর্মশালাটির গড়ে ওঠার গল্পও বেশ মুখরোচক। ১৯০৯ সালে কলকাতা, মুম্বাই ও চিনে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের মাথায় এটি তৈরির পরিকল্পনা আসে। তৈরী হয় মানেকজির নামাঙ্কিত বাংলার প্রথম পার্সি ধর্মশালা। আর সেই তিন বন্ধু ছিলেন মানেকজি রুস্তমজি, নওরোজি পেন্টনজি ও কাওয়াসজি পেন্টনজি। তবে জিভছোঁয়া ‘মসুর মা গোস্ত’ অথবা ‘লাগান নু কাস্টার্ড’ এদের আগমনের গল্প আবার অন্য।এক গুজরাট নিবাসী পার্সি দম্পতি এসেছিলেন কলকাতায়। হেরিটেজ পার্সি খানাকে ভোজনবিলাসী বাঙালির পাতে পৌঁছে দিতে। তাঁরা ছিলেন মেহের হানসোটিয়া ও দারা হানসোটিয়া। দারা সরকারি চাকরি করতেন। মেহের পড়াতেন একটি স্কুলে। বছর আটেক আগে কলকাতা আসেন তাঁরা। ভার নেন রুস্তমজী ধরমশালার রান্নাঘরের।
ষাটোর্ধ্ব এই দম্পতিই পারসিক রান্নার গন্ধ পৌঁছে দেন কলকাতার পাতে। সাধারণ বাঙালির জিভের নাগালে আসে খাঁটি পার্সি খাবার। এঁদের দৌলতেই। নভরোজ উৎসব হলে আকুরা বা ধনসাক খেতে তো ভিড় হতই। তেমনই সাল্লি চিকেন,তারেলা পাপেটা মা মুরগি, চিকেন পোলাও ডাল,এসবের খোঁজেও ভিড় জমতো বেশ। এই মেহেরজির কুইজিনই তো মাতিয়ে রাখত কলকাতা। দুঃখের কথা এটাই, চলতি বছরের জানুয়ারীতে ফিরে গেছেন মেহের ও দারা। পেছনে ফেলে গেছেন শহর ও তার প্রশংসার স্তুপ। খাবারে নেই মেহেরের হাতের ছোঁয়া। খুঁতখুঁতে বাঙালির রসনা বিলাস সেইভাবে ডুবতে পারছে না নু কাস্টার্ডে। সাল্লি চিকেনের সেই স্বাদও পাওয়া যাচ্ছে না ধর্মশালায়। খাদ্যরসিক কলকাতা তাই সর্বান্তকরণে চাইছে, ফিরে আসুক মেহের-দারা। কলকাতায় ফিরুক খাঁটি পারস্যের স্বাদ। আড্ডা জমুক গল্পবিলাসী তেতলা বাড়ির কোনায় কোনায়।
Discussion about this post