এপার বাংলা হোক কিংবা ওপার বাংলা। পোস্ত খেতে ভালোবাসে না এমন বাঙালির সংখ্যা খুবই কম। আফিম ফল থেকে পাওয়া ছোট ছোট কিডনির আকারের এই তৈলবীজ দিয়ে তৈরি খাবারের পদগুলো রসনার তৃপ্তি দ্বিগুণ করে তোলে। তবে শুধুমাত্র স্বাদে নয়; উচ্চ পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এই পোস্তদানায় রয়েছে প্রয়োজনীয় খনিজ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়াম।
স্বাদে গুণে ভরপুর এই পোস্ত দানার ইতিহাস ঘাটলে বেশ আকর্ষণীয় সব তথ্য পাওয়া যায়। বহু প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রে এই পোস্তর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৫০ সালে রচিত ‘ইজিপ্সিয়ান ইর্বাস পেপাইবাস’ নামের পার্চমেন্টে পোস্ত দানাকে প্রশান্তিদায়ক বলে উল্লেখ করা আছে। আবার ব্রোঞ্জ যুগের ক্রিট দ্বীপের আশেপাশে বসবাসকারী মিনোয়ান সভ্যতার লোকজনেরা বাচ্চাদের শান্ত করার জন্যে দুধ, আফিম ও মধুর একটি মিশ্রণ ব্যবহার করতো। শুধু তাই নয়, সুমেরীয় সভ্যতাতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে পোস্তর নাম ও রকমভেদ ভিন্ন প্রকৃতির। অসমীয়ায় আফুগুতি, হিন্দি/মারাঠি ভাষায় খাসখাস, ওড়িয়ায় পোস্তা, বাংলায় পোস্ত, কন্নড় ভাষায় গাসাগাসে, তেলেগুতে গাসগাসালু, তামিলে কাসাকাসা নামে পরিচিত এই তৈলবীজ। বাংলা ছাড়াও মহারাষ্ট্র, গুজরাট, অন্ধ্র, বিহার, ওড়িয়া ও মালাবার রন্ধনপ্রণালীতে পোস্তর ভালো ব্যবহার দেখা যায়। মহারাষ্ট্রে দীপাবলি উপলক্ষ্যে এক বিশেষ মিষ্টি ‘মোয়া’ সাজানো হয় পোস্ত দানা ছড়িয়ে। কর্নাটকে পোস্তর পায়েস আজও ঐতিহ্যবাহী। তবে শুধু ভারতেই নয়। ভারতের বাইরেও পোস্তদানা বেশ জনপ্রিয়। পরিপক্ব চিনি মিশ্রিত গুড়ো করা পোস্তদানা পাস্তার সাথে খাওয়া হয়। আবার দুধ দিয়ে পোস্তদানা সেদ্ধ করে তা পেস্ট্রিতে বা মিষ্টির পুর হিসাবেও ব্যবহার করে। যুগোশ্লাভ অঞ্চলগুলোতে পোস্তদানার পেস্ট্রি ও পাস্তা তৈরির প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। পোলিশ রান্নার পাশাপাশি বিভিন্ন জার্মান পাউরুটি ও ফলাহারেও পোস্তর ব্যবহার দেখা যায়। নিউজিল্যান্ডের আঙ্কেল টবেটে তিন রকমের চিকন করে কাটা পোস্তদানা ও পানীয় দিয়ে ‘লে স্নেক’ নামের একটি খাবার বানানো হয় যা বেশ বিখ্যাত।
বড়দিনের উৎসবে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও পূর্ব স্লোভাকিয়ায় পোস্তদানা দিয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী ফলাহার বানানো হয়। মধ্য ইউরোপে পোস্তদানার স্ট্রুডেল খুবই জনপ্রিয়। বিশেষত বড়দিন উপলক্ষ্যে জার্মানি, পোল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরিতে পোস্ত দিয়ে তৈরি এক পেস্ট্রি ‘মউইনকাচম’ নামে পরিচিত। এটি বেশ বিখ্যাত। ইহুদিদের রান্নায় পুরিমের সময় থেকে কালো পোস্তদানা চিনির সঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট্রিতে পুর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পোস্তর তৈরি ঐতিহ্যবাহী পেস্ট্রি হল ‘কালাচ’ ও ‘হামানটেশ’। পোস্ত দানার তৈরি পেস্ট্রি যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিদের বেকারি ও খাবারের দোকানগুলোর বিখ্যাত খাবার। তবে যে যাই বলুক! আমাদের আলু পোস্ত, পেয়াজ পোস্ত, ঝিঙে পোস্ত বা চিংড়ি পোস্তর স্বাদের কাছে টেক্কা দেওয়া কিন্তু বেশ কঠিন।
Discussion about this post