বঙ্গ জীবনে নানান উৎসব আসে ঋতুকে ঘিরে। তেরো পার্বণের মধ্যে পয়লা বৈশাখ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গাজন চড়কের শেষে আসে এই দিনটি। বাংলা আর্থিক বছরটাও শুরু মার্চ-এপ্রিলে। পুরনো কলকাতায় বাবুরা নববর্ষের বিশেষ দিনে কোঁচানো ধুতি চাদরে উৎসবের মেজাজে মেতে উঠতেন। আমন্ত্রিত থাকতেন বহু অতিথি। বাবুদের বৈঠকখানা সেজে উঠত। সঙ্গে প্রচুর খানাপিনার ব্যবস্থা থাকত।
একবার দ্বারকানাথ ঠাকুর তার নতুন বাগানবাড়িতে সাহেব ও মেমসাহেবদের নিমন্ত্রণ করে আনলেন। অনেক রকম সুস্বাদু খাবার সাহেবগণকে খাওয়ালেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে এবং নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে নববর্ষের সন্ধ্যা মহাসমারোহে কাটলো। এই দিনটিতে ব্যবসায়ীরা গাঢ় লাল রঙের নতুন জাবদা খাতায় মঙ্গলচিহ্ন এঁকে লক্ষ্মী ও সিদ্ধিদাতা গণেশের আরাধনা করেন। সারা বছর নগদ যাঁরা কেনেন না, তারা সাধারণতঃ খাতায় লিখে জিনিসপত্র নিয়ে থাকেন। আর সে খাতায় ধার বাকি খরচের হিসেব বৈশাখের প্রথম দিন মিটিয়ে দেওয়া হয়।
শোনা যায়, মুর্শিদকুলি খাঁ পয়লা বৈশাখের সময় রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা চালু করেন। তখন এর নাম ছিল ‘পুণ্যাহ উৎসব’। চৈত্রের শেষে ধান উঠত খামারে। আর সেই সময়েই রাজস্ব আদায়ের দিনটি বেছে নেওয়া হয়। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনাদায়কৃত রাজস্ব মুকুব করাও হত। ইংরেজদের দেওয়ানি লাভের পরও মুর্শিদাবাদে এই উৎসব পালিত হত। পুরনো কলকাতাতেও নতুন হাল খাতা, নানা রকম মিষ্টান্ন সহ জমজমাট আয়োজন। যদিও সেই হালখাতার আয়োজনে মিষ্টিতে বিদেশি ছোঁয়া পাওয়া যেত না। সবই বাঙালি মিষ্টি। কড়া পাকের সন্দেশ, নরম পাকের জলভরা, কাঁচা গোল্লা, গোলাপ পাপড়ি সন্দেশ, আমের ফ্লেভার যুক্ত হালকা সবুজ আম সন্দেশ, রসগোল্লা, ছানার পায়েস, পান্তুয়া। বাঙালি মিষ্টির তালিকা যেন শেষই হতে চাইত না।
সেই সময় হালখাতার মিষ্টির সঙ্গে নোনতা দেওয়ার রীতি ছিল না বললেই চলে। কখনও যদিও বা নোনতার আয়োজন করা হতো, সেই নোনতাতেও বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। এই যেমন নিমকি, বাঙালি সিঙাড়া ইত্যাদি। তবে শরবত অবশ্যই দেওয়া হত। শরবতে তালিকাতেও বাঙালি নামের ছড়াছড়ি। ডাবের মালাই শরবত ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও গ্রীষ্মের দহন দিনে প্রাণ জুড়নো আম পোড়ার সরবত, লেবু চিনির মিষ্টি শরবত, লিচুর শরবত, ভাজা মশলার শরবতের কদরও কিছু কম ছিল না। ব্যবসায়ীরা নিজের সামর্থ্য মতো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতেন।
তবে পুরনো কলকাতায় বাঙালি গৃহস্থ বাড়িতে কেমন ছিল নববর্ষের আয়োজন? বাঙালি বাড়িতে উৎসবের মহাভোজে কালিয়া ও পোলাওয়ের প্রচলন ছিল। পেঁয়াজ, রসুন ও আদা বেঁটে রস ঘন করে রান্নাকেই সেই সময় কালিয়া বলা হতো। এই কালিয়ার প্রচলন কিন্তু বাঙালি হেঁশেলে মুসলিম আমল থেকেই চলে আসছে। তবে বাঙালি হিন্দুরা সেই কালিয়ার ধরনটা সামান্য বদলে নিয়েছিলেন। অবাঙালি বা মুসলিম ঘরানায় কালিয়া বলতে শুধুই মাংস বোঝানো হয়। কিন্তু হিন্দু ঘরে আমিষ ও নিরামিষ দুই রকম কালিয়াই প্রচলিত। আমিষের মধ্যেও আবার আমরা মাংস ছাড়া মাছেরও কালিয়া বানাতে অভ্যস্ত। এছাড়াও নিরামিষ কালিয়ার সব্জির মধ্যে এঁচোড় খুবই জনপ্রিয়। এই কারণেই বোধহয় বাঙালিদের কাছে এঁচোড় গাছা পাঁঠা নামেও পরিচিত। আর পোলাও অর্থাৎ ঘিয়ে ভেজে ভাত রান্না। তার সঙ্গে নানা রকম মোগলাই মশলা যুক্ত হয়ে এক অন্য ধরনের স্বাদ আসত রান্নায়।
নিরামিষের মধ্যে মাছের পাশাপাশি বাহারি মাটনের আয়োজন অবশ্যই থাকত। মাংসের মধ্যে কচি পাঁঠার বাঙালি ঝোল যেমন হতো তেমনই মুসুর গোস্ত, কালেজি দমপক্ত, শাহী মুরগা কোর্মা ইত্যাদিও হতো। পুরনো কলকাতায় নববর্ষে বাঙালি পরিবারেও, বিশেষত জমিদার বা বনেদি পরিবারে, মাংসের পোলাও রাঁধা হতো। সেই পোলাওয়ের জন্য হাড় ছাড়ানো মাংসের সঙ্গে জায়ফল, জয়ত্রী, গরম মশলা, শাহী মশলা ও প্রচুর পরিমাণে ঘি আনানো হতো। শেষ পাতের জন্য দেশি বিদেশি সব ধরনের মিষ্টিরই আয়োজন থাকত। লাউয়ের বরফি, মালপোয়া, গোলাপজাম, আতার রাবড়ি, দুধ গাজরের হালুয়ার পাশাপাশি আবার ব্যানানা ডেজার্ট, মিল্ক বরফি, আপেল স্নো পুডিং, চকোলেট পুডিং, চায়না গ্রাস স্পেশাল পুডিং ইত্যাদিও বানানো হতো। তবে শেষ পাতে কুলফি কিংবা আইসক্রিমের প্রচলন ততটা ছিল না। কুলফি অবশ্য পরবর্তীকালে বনেদি বাড়ির নববর্ষে ভোজের অঙ্গ হয়ে ওঠে। জাফরানি কুলফি, দুধ মালাই কুলফি, মেওয়া কুলফি, বাদাম কুলফি, পাকা আমের কুলফির পাশাপাশি একটু ইংরেজ কেতা দূরস্ত পরিবারে ভ্যানিলা কুলফি, চকোলেট কুলফি, রোজ কুলফি ইত্যাদিও পরিবেশন করা হত।
চিত্র ঋণ – বঙ্গ ভিটা
Discussion about this post