রাধাশ্যাম জুটির মতোই হুগলির দুই শহর। উত্তরপাড়া আর ভদ্রকালী। উচ্চবর্গদের বাস উত্তরপাড়াকে পূর্ন করলেও ভাদ্রকালীতে তেমন জমিদারি ছিল না। তবে ভদ্রকালীর বন্দোপাধ্যায়দের জমিদারি ছিল উল্লেখযোগ্য। ভদ্রকালী মাতার নামানুসারে এ শহরের নাম ভদ্রকালী। যেখানে শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায় প্রায় তিনশো বছর আগে ভদ্রকালীর মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তবে এ মন্দির আজ আর নেই। দোল মঞ্চের কাছে নতুনভাবে ভদ্রকালীর মন্দিরটি নির্মাণ করেন জ্যোতিপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় (ম্যাকা বাবু), হরিহর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে।
এ মন্দিরের পেছনে রয়েছে রাম, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন এবং সীতা সহ রাম মন্দির। আর পশ্চিমদিকে রয়েছে রাধা গোবিন্দ বিগ্রহ। এই রাধা গোবিন্দকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয় দোল উৎসব। প্রাঙ্গণ রেঙে ওঠে নানান রঙে। দোলের আগের দিন চলে শোভাযাত্রা। শহর প্রদক্ষিণ করেন রাধাগোবিন্দ জিউ। সঙ্গে থাকে আলো আর কীর্তন। ভগবানকে ঘিরে ভক্তদের সমাগমে আগে পুরোভাগে থাকতেন বেণীমাধব ঘোষ লেনের শম্ভুনাথ গোস্বামী। গোটা অনুষ্ঠানের আরেক আকর্ষণ ছিল মেলা। সেখানে খেলনা থেকে শুরু করে বাসন-কোষন সব তখন পাওয়া যেতো ছ আনায়। সেই একটা গান ছিল না, “নিলাম ওয়ালা ছ আনা লে লে বাবু ছ আনা যা নেবে তাই ছ’আনা।” এ যেন ঠিক তাই।
এরপর সময় আসে ন্যাড়া পোড়ার পালা। যার আরেক নাম চাঁচর। সঙ্গে চলতে থাকে বাজি পোড়ানো উৎসব। ষাটের দশকে ডানকুনি কালিপুর থেকে লোক আসতো বাজির প্রদর্শনী করতে। দোলযাত্রাকে ঘিরে এ বিরাট মেলার কোনো সীমা ছিল না প্রথমে। পরে যদিও ঠিক করা হয় মেলা হবে পনেরো দিনের। সে মেলায় জিলিপির দোকান থেকে শুরু করে থাকতো লটারির দোকানও। আর সঙ্গে ছিল জনপ্রিয় অনুষ্ঠান পুতুল নাচ। যা দেখার জন্য দূর দূরান্ত থেকে আসা লোকের ভিড় জমতো। এছাড়া ছিল লাট্টু খেলা। আর অসীম দক্ষতার সাথে সেই লাট্টু ঘুরিয়ে হাতে তুলে নেওয়া কোনো এক বালক।
বর্তমানে মেলার পরিধি গঙ্গার ধার থেকে শুরু হয়েছে। জায়গা কমে যাওয়ার ফলে দোলনা আর নেই, শুধুই দোল। তবে প্রাচীন মেলার সবটুকু চলে যায়নি। মেলার দিকটা ছেড়ে বাকি অনুষ্ঠান একইরকম চলে। নবীন প্রজন্ম বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে আপ্রাণ চেষ্টায় রয়েছে ঐতিহ্য বজায় রাখার। তবে মেলার আনন্দে ভাটা পড়েনি একেবারেই। শুধু রূপ পাল্টেছে মাত্র। পনেরো দিনের এই মেলা এখনও একইভাবে জমজমাট।
Discussion about this post