আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই শিল্পী আসলে জাদুকর। শিল্পের জাদুকর! জাদুর ছড়ি হাতে নয়, এক টুকরো শোলা হাতে পেলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত বাকি পৃথিবী। তিনি মধুমঙ্গল মালাকার। যাঁর সৃষ্টি ইন্দ্রজালে জীবন পেত শোলার এক একটি প্রতিমা থেকে মুখোশ! তবে হঠাৎ করেই থমকে গেল তাঁর পথ চলা। ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে জয়ী হল জীবনের ধ্রুব সত্য! ১৩ জানুয়ারি সকাল ১১:৩০, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে। বয়স মাত্র ৬২।
দক্ষিণ দিনাজপুরের এক ছোট অখ্যাত গ্রাম মুস্কিপুর। হঠাৎ করেই একদিন সেই গ্রাম সংবাদপত্রের শিরোনামে। এই গ্রামের বাসিন্দা মধুমঙ্গল মালাকারের শোলার তৈরী প্রতিমা, মুখোশ স্থান পেয়েছে লন্ডন মিউজিয়ামে! তারপর একে একে ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট, এডিনবরা, সানফ্রান্সিসকো থেকে স্কটল্যান্ড! এই বঙ্গে শোলা শিল্প যথেষ্ট কদর না পেলেও তাঁকে চিনতে ভুল করেনি বিদেশের মাটি। সেই আক্ষেপকে মনে জিইয়ে রেখেই তাঁর হাতে প্রাণ পেয়েছে একের পর এক শোলার অবয়ব। কখনো মুখোশ, কখনো মূর্তি, কখনো মনসার পট আবার কখনও তাজিয়া।
বাবা তরুণীকান্ত মালাকারের কাছেই শোলা শিল্পে হাতেখড়ি ছোট্টো মধুমঙ্গলের। বাবা যখন কাজ করতেন দেখতেন মন দিয়ে, মাঝেসাঝে হাতও বাড়াতেন তাতে। শিল্পী মনের ক্ষুধাই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় মুম্বাইয়ের জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে। বয়স তখন মাত্র ২১। জহুরির চোখ চিনতে ভুল করেনি এই রত্নকে। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। পরবর্তীতে কাজ করেছেন মুম্বই ফিল্ম ডিভিশনে। তিনিই একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুম্বই ফিল্ম ডিভিশনের প্রদর্শনী ও ওয়ার্কশপে ডাক পেয়েছিলেন। শোলা শিল্প বলতে শুধু ডাকের সাজ কিংবা বরের টোপর আর কনের মুকুট নয় মানুষের এই ধারণা ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তবে এই বিশ্বজোড়া খ্যাতি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিসরেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। পশ্চিমবঙ্গের দুঃস্থ হস্ত ও কুটির শিল্পীদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন পুরোদমে। বঙ্গীয় পারস্পরিক সংগঠনের মুখ্য সংগঠক ছিলেন তিনি। তাঁরই উদ্যোগে ২০১৭ সালে কলকাতা প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে শুরু হয় গ্রামকৃষ্টি উৎসব। কিন্তু হঠাৎ করেই বিপদের মেঘ ঘনিয়ে আসে ক্যান্সার। তাঁকে ভর্তি করানো হয় কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে। অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর মৃতদেহ কলকাতা থেকে বালুরঘাটে আনার ব্যবস্থা করেন। সততই এই মৃত্যু শিল্প মহলে যে শূন্যস্থান সৃষ্টি করে গেল তা অপূরণীয়।
Discussion about this post