কবিগুরুর ভাষায় “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর।” তাঁর সেই আকুতি আজকের এই যুগে অরণ্যে রোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিনিয়ত মানুষ কেটে সাফ করছে বনজঙ্গল ও জনজীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে। চিপকো আন্দোলনের কথা তো আমাদের সকলেরই জানা। সেদিন আন্দোলনের মুখ্য কর্মসূচি ছিল বনভূমিকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে রক্ষা করা। সভ্য সংস্কৃতির মেরুদণ্ড অরণ্য সম্পদ। আর সেই অরণ্য ধ্বংস হলে তা কতটা প্রভাবিত করতে পারে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বারবার। এমন উপলব্ধি থেকেই কেনিয়ার কিপসিগিস আদিবাসীরা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ৯০হাজার গাছ বসিয়ে ফেলেছেন।
বন্যপশুদের অন্যতম বৃহৎ আবাসভূমি পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া। এটি নীল ওয়াইল্ড বিস্টের জন্য বিখ্যাত। এটি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থান। আর কেনিয়ার চেপালুঙ্গুর বনভূমি ২০০৭ সাল থেকে নির্বিচারে ধ্বংস হতে থাকে। ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছিল কেনিয়ায়। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে। তার আঁচ এসে পড়ে চেপালুঙ্গুর গায়ে। একের পর এক নির্বিচারে কাটা হয় আফ্রিকান ওয়াইল্ড অলিভ, সেডার, লাল স্টিংকউড, ন্যান্ডি ফ্লেম গাছ। অরণ্যের অর্ধেকের বেশি সাফা হয়ে যায় মানুষের হাতে। এই গাছ হত্যাকে সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিপসিগিস গোষ্ঠীর প্রধান প্রকৃতি প্রেমিক জোসেফ টোওয়েট। তাঁর স্মৃতিচারণেও উঠে এসেছিল সেই কথাই।
নির্বিচারে অরণ্যের এমন ধ্বংসের সরাসরি প্রভাব এসে পড়ে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের ওপর। কিপসিগিস গোষ্ঠীর জীবনযাত্রাও প্রভাবিত হয় এই ঘটনায়। তারা শুধুমাত্র এই অরণ্যকে ভেষজ উপাদানের সংগ্রহশালা হিসেবেই মনে করেন না। তাদের কথায় এই অরণ্য এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জোসেফ তাদের এই অরণ্যভূমিকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছিলেন। তারপর ২০০৮ সালে গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘চেপালুঙ্গু এপেক্স কমিউনিটি ফরেস্ট অ্যাসোসিয়েশন’।
চেপালুঙ্গুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সবুজায়নের গুরুদায়িত্ব বর্তমানে জোসেফ এবং কিপসিগিস গোষ্ঠীর কাঁধে। এই বিরাট কর্মযজ্ঞে এখন যোগ দিয়েছে ইউ এস ফরেস্ট সার্ভিস, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড ফর নেচার এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও। প্রায় ৪,৮৭১ হেক্টর জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কেনিয়ার চেপালুঙ্গু অরণ্য যেন আবার প্রান ফিরে পাচ্ছে। সেখানকার স্থানীয়রা বুঝতে পেরেছেন যে ভালোবেসে প্রকৃতিকে কিছু দিলে, প্রকৃতি তার দশগুণ ফিরিয়ে দেবেই। তাই এই অরণ্যভূমিকে রক্ষার আলেখ্য বিশ্ববাসীর কাছে এক দৃষ্টান্ত।
Discussion about this post