ভাত, ভিটে ও বসনের মৌলিক প্রয়োজনের বাদে যদি জীবনের অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা বেঁচে থাকে তাহলে সেটা চিকিৎসা পরিষেবা। শরীরের সুস্থতা ও নানা ব্যাধির হাত থেকে আরোগ্য লাভের জন্য আমরা চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই ভরসার জায়গা যখন চরম ভোগবাদের কবলে পড়ে মুনাফা লাভের কেন্দ্র হয়ে ওঠে তখনই বিপন্নতা গ্রাস করে আমাদের। আকছার চিকিৎসা সম্পর্কিত ‘কালো সংবাদ’ প্রায় আমাদের গোচরে আসে, ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন ‘কর্পোরেট অফিসে’ পরিণত হয়ে জনসাধারণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
সরকারি হাসপাতালের বেহাল দশা। অগত্যা খড়কুটোর মতো বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ভারতে ব্যাঙের ছাতার মতো তাই গজিয়ে উঠছে প্রাইভেট হসপিটাল। বর্তমানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে যার অংশীদারী বেড়ে ৬২ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান বেসরকারি মুনাফাখোর হাসপাতালের ভ্রষ্টাচারের সত্যতা মেনে নিয়েছে নিকট অতীতে ভারতের সংসদীয় কমিটিও। দেশের অগ্রণী সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাইভেট হাসপাতালের পরামর্শে ঘটানো ৪৪ শতাংশ সার্জারিই অপ্রয়োজনীয়। যার মধ্যে রয়েছে হার্ট সার্জারি, জরায়ুর অপারেশন,ক্যান্সার সম্পর্কিত শল্য চিকিৎসা, হাঁটু প্রতিস্থাপন ও সিজারিয়ান বা ‘সি-সেকশন’ সার্জারির মতো অতি পরিচিত চিকিৎসা পরিষেবা।
বেসরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি বিষয়ক গবেষণায় উঠে এসেছে গা শিউরে দেওয়ার মতো তথ্য। ভারতের শীর্ষ স্থানীয় হাসপাতালের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ ডাক্তার ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ম্যানেজমেন্ট টিমের বক্তব্য অনুযায়ী চিকিৎসকদের প্রতি মাসে কমপক্ষে হাজারখানা রুগীকে বহির্বিভাগ থেকে হাসপাতালের মূলস্রোত চিকিৎসা পরিষেবা নিতে বাধ্য করা হয়। তাই বেশি থেকে বেশি সার্জারির পরামর্শ দিতে হাত কাঁপছে না চিকিৎসকদের। ব্যতিক্রমী চিকিৎসকরা নীতির পথ অনুসরণ করলে মোটা মাইনের চাকরি খোয়াতে হচ্ছে যখন তখন। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের চাকরি চুক্তিভিত্তিক। প্রতি বছর তাঁদের বেতন কাঠামো নবীকরণের ক্ষেত্রে বিগত বছরের ‘পারফর্মেন্স’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভিত্তি। এহেন ‘কর্পোরেট কালচার’ জীবিকা ও জীবনের মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরোক্ষে আরও জটিল ও ঘৃণ্য অপরাধের সীমানা অতিক্রম করতে বাধ্য করছে।
ব্যাপক স্তরে অসাধু ব্যবসায় জড়িয়ে আছে বেশ কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার যারা ভুল রিপোর্ট দিয়ে বিভ্রান্ত করছে রুগীদের। এই সব অসাধু সংস্থা চালান করে দিচ্ছে এরপর রুগীদের একই দলে জড়িয়ে থাকা ডাক্তারদের কাছে, যাদের মাধ্যমে রোগী ভর্তি হচ্ছেন সর্বস্ব খুইয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা নার্সিং হোমে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর একটা মোটা অংশ ‘এনএবিএল অনুমোদন’ ছাড়াই রমরমিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। চিকিৎসকদের এই সব পরীক্ষাগারে নানা টেস্ট করানোর ‘রেফারেন্সের’ জন্য দেওয়া হচ্ছে কমিশন। বাদ যাচ্ছে না শীর্ষ স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোও। চিকিৎসকদের কমিশন সহ বিভিন্ন আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে তারা মুক্ত চিত্তে। এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে সক্ষম। এই আঁধারের শেষ কোথায়, সাধারণ মানুষের প্রশ্ন এখন সেটাই।
Discussion about this post