“জলে কুমির ডাঙায় বাঘ” – সুন্দরবন শুনলেই ভেসে ওঠে মনের দৃশ্যপটে দুই বাংলা জুড়ে বিরাট ব-দ্বীপ আর ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। ফুটে ওঠে সোঁদা মাটি নোনা জলে জেলেদের জীবন ও প্রকৃতির আক্রোশের সামনে বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়া মানুষের অনুজ্জ্বল কাহিনী। সাধারণত ঐতিহাসিক গুরুত্ব সন্ধানে আমরা সুবিশাল এই বনভূমিকে প্রথম সারিতে রাখি না। কিন্তু তাতে ইতিহাসের কিছু যায় আসে না। যায় আসে না বলেই নিকট অতীতে উঠে এসেছে খুলনা জেলার শেখেরটেকের মধ্যযুগীয় কালী মন্দির। ইতিহাসবিদদের গবেষণার আলোকবৃত্তে তাই ধ্বংসের কবলে জরাজীর্ণ এই মন্দিরটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সুন্দরবনের ঐতিহাসিক গুরুত্বের সাক্ষী এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার নিঃসন্দেহে আলোড়ন তুলেছে ইতিহাস প্রেমীদের মনে।
নদীপথে বাংলাদেশের খুলনা শহর থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে শিবসা নদীর পূর্ব পাড়ে শেখের খাল ও কালীর খালের মাঝে মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের যা ভগ্নাংবশেষ পাওয়া যায় তা ইটের দেওয়াল ও ঢিবিই মূলত। কিন্তু টিকে আছে যেটা কালের প্রবাহে আজও তা বিস্ময় জাগানো সুপ্রাচীন কালী মন্দির। আনুমানিক ৪০০ বছর ধরে বিস্মৃতির ধোঁয়াশায় ঢাকা মন্দিরটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। তৈরী হয়েছে মুঘল আমলে নির্মিত এই দেবালয়টি ঘিরে ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরটির বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অবলোকন অনুযায়ী অশেষ গুরুত্বের।
প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ বছর আগে নির্মাণ করা হয় এই মন্দিরটি। স্থাপত্য শৈলী, কাঠামো ও নকশা মন্দিরটির এক সময়ের গৌরবের কথা সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করে। পোড়ামাটির চার ধরণের ইট সহ ফুল-পাতা ও জ্যামিতিক নকশার অবশেষ তদানীন্তন শৈল্পিক উৎকর্ষতার বার্তাবাহক। এক গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের প্রবেশদ্বার ও প্রশস্ত প্রবেশপথ মন্দিরকে প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে মধ্যযুগীয় স্থাপিত্যকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরেছে। তবে পাদপ্রদীপের আলো থেকে কয়েক শতাব্দী আড়ালে থাকা স্থাপত্যের অবস্থা যথেষ্ট শোচনীয়। পুরাতত্ব বিভাগ তাই এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে।
শেখেরটেকের কালী মন্দিরটির উল্লেখ সুন্দরবন সংক্রান্ত ইতিহাসের নথিপত্র ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। সতীশ চন্দ্র মিত্রের গ্রন্থ ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’, এ এফ এম আব্দুল জলীলের গ্রন্থ ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ ইত্যাদিতে শেখেরটেক অঞ্চলের এই ঐতিহাসিক অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়। সতীশ চন্দ্র মিত্র তাঁর গ্রন্থে এই অঞ্চলটিকে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের শিবসা দূর্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বসতি অঞ্চলের সম্ভাবনাকে সমর্থন করলেও বাসিন্দাদের প্রসঙ্গে উল্লেখ পাওয়া যায়নি তাঁর গ্রন্থে। তবে কালী মন্দিরটির ভূয়সী প্রশংসা তিনি করেছেন। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও কারুকাজ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মুঘল আমলে পর্তুগীজ জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সামরিক ঘাঁটি তৈরী করা হয় এই অঞ্চলে। এই অঞ্চল ঘিরে গড়ে ওঠে জনবসতি। হিন্দু কর্মচারীদের পূজাস্থল হিসেবে তৈরী হয় শেখেরটেকের কালী মন্দিরটি। মতান্তরে ‘শেখের বাড়ি’ হিসেবে অঞ্চলটি প্রচলিত হলেও বনবিভাগের মতে এটা মহারাজ প্রতাপাদিত্যের শিবসা দুর্গই।
পর্যটকদের সুবিধার্থে বনবিভাগ শেখের খাল থেকে কালীমন্দির অবধি ১২৫০ মিটারের একটা কংক্রিটের ফুট ট্রেইল নির্মাণ করেছে। মন্দিরকে আবর্তন করে পর্যটকরা ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারবেন সহজেই। রয়েছে একটা ওয়াচ টাওয়ারও। প্রকৃতি ও পুরনো দিনের আজও না ফুরনো ইতিহাসের যুগলবন্দী পর্যটকদের মন কেড়ে নেবেই।
Discussion about this post