যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ভারতের ভাষা দিবস কবে তাহলে এক কথায় অনেকেই বলবেন ২১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু যদি একটু ইতিহাস ঘাঁটা যায় তাহলে দেখা যাবে ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও বলিদান রক্তে রাঙা হয়ে রয়েছে ভারতের ইতিহাসে। আজ থেকে প্রায় ৫৯ বছর আগের ঘটনা। সালটা ১৯৬১। সে সময় অসমে ছিল প্রচুর সংখ্যক বাঙালির বাস। অসমের কাছাড় জেলার শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে থাকতেন হাজার হাজার বাঙালি। সে সময় অসমীয়ারা মনে করেছিলেন, বিপুল সংখ্যক বাঙালির বাস তাদের অধিকারকে খর্ব করছে। আর বাঙালিদের জন্য যখন আলাদা একটি রাজ্য রয়েছে, তখন তারা অসমে থাকবে কেন? এরকম জাতি বিদ্বেষী মনোভাব জন্ম দেয় ভয়াবহতার। অসমে বাড়তে থাকে বাঙালিদের বহিষ্কারের আশঙ্কা। আর এই পুরো ঘটনা আরও উসকে দেয় অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির একটি সিদ্ধান্তে। ১৯৬০-এর এপ্রিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অসমীয়াই হবে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা। অর্থাৎ বাঙালিদেরও অসমীয়াতেই কাজ সারতে হবে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে পড়ে প্রাণ ভয়ে অসম ছেড়ে পালাতে থাকে প্রচুর বাঙালি। প্রাণও যায় অনেকের। এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে, অসমের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা ঘোষণা করেন, অসমীয়াই হবে রাজ্যের সরকারি কাজকর্মের ভাষা। ফলতঃ বাড়তে থাকে উত্তেজনা। পরিস্থিতি আরো জটিল হয় অসম সরকার ও বাঙালিদের মধ্যে।
১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের দিনটি এই সংগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। শিলচরের কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সংকল্প নেয়া হয় এই দিনে। উদযাপিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। ভাষা আন্দোলনকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। ২২৫ মাইল পথ পেরিয়ে ২ মে তারা পৌঁছয় করিমগঞ্জে। এই পদযাত্রা আরম্ভের ঠিক একমাস পরে ১৯ মে দিনটি ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন। ১৯ মে বরাক উপত্যকায় হরতালের ডাক দেওয়া হয়। আর ঠিক তার আগের দিন ১৮ মে হরতালের আগের দিন রাতে করিমগঞ্জে ব্যাপক ধর-পাকড় চালায় পুলিশ। হামলা হয় গণ পরিষদের কার্যালয়ে। রাত বারোটায় করিমগঞ্জ গণসংগ্রাম পরিষদের অফিসে হানা দিয়ে পরিষদের অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতা সংগ্রামী রথীন্দ্রনাথ সেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। রাত সাড়ে তিনটার সময় যুবশক্তি সম্পাদক বিধুভূষণ চৌধুরীকেও গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও গ্রেফতার হন জেলা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নলিনী কান্ত দাস, ছাত্র নেতা নিশিথ রঞ্জন দাস সহ আরও অনেক কর্মী। পুলিশের এরকম আচরণে ফুঁসে ওঠে জনতা।
১৯ মে সকাল থেকে সর্বত্র হরতাল চলতে থাকে। শিলচর রেলস্টেশনে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের জন্য জড়ো হয় হাজার হাজার ছাত্র যুবক জনতা। সাথে চলতে থাকে স্লোগান – “মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ৷” ১৪৪ ধারা অমান্য করায় অনেক সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উত্তেজিত জনতা শিলচর স্টেশনে রেল অবরোধ করে। অবরোধ তুলতে পুলিশ গুলি চালায়। সেই গুলিতেই শহিদ হন ১১ জন ভাষা সৈনিক। প্রচুর তাজা প্রাণের বিনিময় প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা ভাষা। অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলাভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেন। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা-আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা সেখানকার বিধান সভায় স্বীকৃতি পায়। আর তার সাথে সাথেই ভারতের ইতিহাসে স্থান পায় ১৯ মে।
Discussion about this post