অলবিউরি ১৮ ই মার্চ, ১৯৯২। অস্ট্রেলিয়ার ল্যাভিংটন স্পোর্টস ওভাল স্টেডিয়ামে বেনসন আন্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড কাপের ৩৫ নং ম্যাচ জিম্বাবোয়ে বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যে। নানা ধরনের মানুষের উল্লাস, উচ্ছাস, উত্তেজনায় গোটা স্টেডিয়ামে তখন এক গমগমে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সেই সময়ের এক অন্যতম জনপ্রিয় টিম ইংল্যান্ড। শেষের ছয়টা ম্যাচের পাঁচটা ম্যাচেই অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে ইংল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ ১০ পয়েন্ট নিয়ে জয় লাভ করেছিল। উল্টোদিকে তখনো ‘টেস্ট স্ট্যাটাস’ না পাওয়া জিম্বাবুয়ে আগের প্রায় সমস্ত ম্যাচেই লজ্জাজনক হারের মুখ দেখেছিল।
খেলার শুরুতেই টসে জিতে প্রথম ফিল্ডিং করার সুযোগ নিজেদের হাতে তুলে নেন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন গ্রাহাম গুচ। ব্যাট হাতে ক্রিজে নামেন জিম্বাবোয়ের দুই ওপেনার ওয়ানে জেমস ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। কিন্তু ব্যাট করতে নেমে ফিল ডিফ্রেটিয়াস, ইয়ান বোথাম, রিচার্ড ইলিংওয়ার্থদের মতো দুর্দান্ত বোলারদের বোলিংয়ের দাপটে শুরুতেই ওয়ানে (১৩) এবং ফ্লাওয়ার (৭) উইকেট হারিয়ে ফিরে যান। মাত্র ৩৩ রান তুলতেই ৪ টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট হারিয়ে ফেলে আফ্রিকার দেশটি। এরপর ব্যাট হাতে মাঠে নামে জিম্বাবোয়ের ক্যাপ্টেন ডেভ হটন। দীর্ঘ ৭৪ বল খেলা শেষে সর্বোচ্চ ২৯ রান টিমকে দিয়ে ফেয়ারব্রাদার বি স্মলের ক্যাচে মাঠ থেকে ফিরে আসেন হটন। একের পর এক উইকেট পড়তে পড়তে ৭ উইকেটের শেষে জিম্বাবোয়ের সংগ্রহে আসে মাত্র ৯৬ রান। পরে ‘দুই পেসার’ ইয়ান বুচার্ট (২৪) ও এডো ব্র্যান্ডেস (১৪) অষ্টম জুটিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৩১ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করতে সক্ষম হযন। অবশেষে ৪৬.১ ওভারে অল আউট হয়ে ১৩৪ রান করে জিম্বাবুইয়ানরা। শুরু হয় মধ্যাহ্ন বিরতি।
ল্যাভিংটন স্পোর্টস ওভালে তখন খেলা দেখতে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন অন্যতম সাবেক ইংলিশ কিংবদন্তি জিওফ্রে বয়কট। যিনি জিম্বাবোয়ের খেলা দেখার পর বলেন, ”আমেচার দলগুলির একটা পুরনো সমস্যা হল যে, তারা জানে না কীভাবে স্ট্রাইক রোটেট করতে হয়। লাঞ্চের বাইরে বেরিয়ে দেখো, পেশাদাররা কীভাবে খেলে। তারা শুধু ফাঁকে ফাঁকে বলগুলো ঠেলে এক দুই রান বের করবে আর সহজেই ম্যাচটা জিতে যাবে।” বয়কট এর কাছ থেকে এই ধরনের অবজ্ঞা সূচক কথা শোনার পর জিম্বাবোয়ের পুরো টিম প্রথম বারের মতো দেখেছিল একরোখা জেদি লড়াকু সৈনিকের মতো অন্য ডেভ হটনকে। পুরো টিমকে উদ্দেশ্য করে হটন বলেছিলেন যে, “ফলাফল নিয়ে ভেবো না। আজ আমাদের হারানোর কিছুই নেই। নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করবো আমরা।” শুরু হয় সেকেন্ড হাফ। ব্যাট হাতে মাঠে নামে দুই ইংলিশ ওপেনার গ্রাহাম গুচ ও ইয়ান বোথাম। মাঠে নেমে জিম্বাবোয়ের ডানহাতি পেসার এডো ব্র্যান্ডেজ প্রথম বলেই দুর্দান্ত বোলিং করে উইকেট নেন ইংলিশ ক্যাপ্টেন গ্রাহাম গুচের। প্রথম কয়েক ওভার বোলিংয়ের পরই ব্র্যান্ডেজ একে একে ব্রিটিশদের উইকেট নিতে থাকেন। তার দুর্দান্ত বোলিংয়ের সামনে পরে অ্যালান ল্যাম্ব (১৭), রবিন স্মিথ (২), গ্রেম হিকের (০) মতো অত্যন্ত পারদর্শী ইংরেজ খেলোয়াড়দের একে একে উইকেট পড়তে থাকে। টানা ১০ ওভারের শেষে ব্র্যান্ডেজ মাত্র ২১ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলো ৪ টে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উইকেট।
এর মাঝেই ১৮ রানের ইনিংস খেলে অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম খেলা ঘোরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু খানিক সময়ের মধ্যেক এই চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে ক্যাচ লুফে বোথামকে মাঠ ছাড়া করেন জিম্বাবোয়ের আর এক ডানহাতি পেসার ওমর শাহ। মাত্র ৪৩ রানের বিনিময়ে ইংল্যান্ড হারিয়ে ফেলে ৫ টা উইকেট। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ইংল্যান্ডের হয়ে ব্যাট হাতে নামে নেইল ফেয়ারব্রাদার ও অ্যালেক স্টুয়ার্ট। এই দুই ব্যাটসম্যানের ৫২ রানের বড় পার্টনারশিপ জিম্বাবোয়ের মনোবল সেই মুহূর্তের জন্য কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু এরপরেই ৯৫ রানের মাথায় স্টুয়ার্টের (২৯) ক্যাচ ধরে ফের একবার নিজেদের হাতে ম্যাচ ঘোরান ওমর শাহ। এর অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানেই ফিল ডিফ্রেটাস (৪) ও নেইল ফেয়ারব্রাদারের (২০ পর পর উইকেট নিয়ে নিজের টিমের জয় সুনিশ্চিত করে আরো একট ধাপ কাছে নিয়ে যায় আর এক ডান হাতি পেসার ইয়ান বুচার্ট। এরপর ব্যাট হাতে মাঠে নামে রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ ও গ্ল্যাডস্টোন স্মল, দু’জন মিলে ১৬ রানের পার্টনারশিপে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল চেষ্টা করলেন। ঠিক তখনই মাত্র ১১ রানের বিনিময়ে রান আউটের শিকার হয় ইলিংওয়ার্থ। ৪৯ ওভার শেষে সেই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টিম ইংল্যান্ডের সংগ্রহে আসে মাত্র ১২৫ রান৷ টার্গেট ১৩৫, জিততে হলে দরকার আর ১ ওভারে ১০ রান।
সারা মাঠ জুড়ে তখন এক টান টান উত্তেজনা। অবশেষে জিম্বাবোয়ের পক্ষ থেকে বল হাতে শেষ ওভার করতে আসেন জিম্বাবুয়ের ফাস্ট বোলার ম্যালকম জার্ভিস। ক্যাপ্টেন হটন তাঁকে শুধু একটাই কথা বলেছিলেন। ‘ভয় পেও না, আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।’ হটনের বিশ্বাস বিফলে যায়নি সেদিন। শেষ ওভারে বল করতে নেমে তার প্রথম বলেই ইংল্যান্ডের দশ নম্বর ব্যাটসম্যান গ্ল্যান্ড স্টোনকে (৫) ক্যাচ আউট করে দেন৷ শেষ হয় যুদ্ধ। ইংল্যান্ডের দম্ভকে নস্যাৎ করে জিম্বাবুইয়ানরা ৯ রানে অদ্ভুত জয়লাভ করে৷ এই অভূতপূর্ব জয় সেদিন জিম্বাবুয়ের ‘টেস্ট স্ট্যাটাস’ পাওয়ার দরজা খুলে দিয়েছিল। ম্যাচ শেষে ৪ টে উইকেট নিয়ে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ ঘোষণা করা হয় ফাস্ট বোলার এডো ব্র্যান্ডেজকে।
এতকিছুর পরে একটা প্রশ্নই থেকে যায়। বয়কট কী বললেন খেলা দেখে? শোনা যায় ম্যাচ শেষে মাঠে আর সেদিন বয়কটকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। খেলা শেষে তিনি চুপচাপ স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যান। হটন আর তাঁর টিমকে বলা কথাগুলো সেদিন আশ্চর্যজনকভাবে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিল জিম্বাবুয়ের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে। জন্ম দিয়েছিলো অন্য হটনের যিনি হারের আগে হেরে যাননি এবং হারতে দেননি। হটনের কথার ফুলকি গোটা টিমকে নিয়ে আগুন হয়ে ঝরে পড়েছিল সেদিন ল্যভিংটন স্পোর্টস ওভালে। মানুষ সাক্ষী থেকেছিলো হার মানতে না শেখা এক অনন্য জয়ের লড়াইয়ের গল্পের।
Discussion about this post