সত্যি মিথ্যের যাঁতাকলেই আমাদের নিত্যদিনের জীবন। সত্যিকে আড়াল করতে মানুষ সহজেই জড়ায় মিথ্যের মুখোশ। আর হবে নাইবা কেন, ঘোর কলি বলে কথা। তবে পুরাণের কথায় একটা যুগ ছিল যেখানে নাকি মানুষের মুখে মিথ্যের বিন্দুমাত্র বাস ছিল না। মহাভারতের পান্ডব জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, যিনি নাকি মিথ্যে বলতেই পারেন না। তাই তো আজও কেউ সত্যি বললে আমরা বিদ্রুপ করে বলি,’সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’। কিন্তু জানেন কি এই যুধিষ্ঠিরের মুখেই সময় বিশেষে শোনা গেছে মিথ্যেও। এমনকি জীবনপথে জুটেছে কঠোর শাস্তিও। আসুন তবে যাচাই করি যুধিষ্ঠিরের সত্যি মিথ্যের আলোছায়া।
কুরুক্ষেত্রের রক্তাক্ত মঞ্চে তখন দ্রোণপর্ব। কৌরব সেনাপতি আচার্য দ্রোণ চিরকালই হস্তিনাপুরের সিংহাসন রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই স্নেহের মায়া ত্যাগ করেই মেতেছেন শত্রুপক্ষ পান্ডব সেনার ধ্বংসলীলায়। এদিকে শিক্ষাগুরু দ্রোণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ওঠাতে তাঁরই প্রিয় শিষ্য পরাক্রমী অর্জুন সংকোচে দ্বিধাগ্রস্ত। তাই শ্রীকৃষ্ণের কূটচালে যুদ্ধ চলাকালীনই অশ্বথামা নামের একটি হাতিকে মেরে রটিয়ে দেওয়া হয় ‘অশ্বথামা হত’। এদিকে গুরু দ্রোণের একমাত্র পুত্রের নামও অশ্বথামা। তাই একরকম মর্মাহত শরীরেই গুরু দ্রোণ সত্যি মিথ্যের যাচাইয়ে ছুটে আসেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। আর সেই সুযোগেই যুধিষ্ঠির উঁচুস্বরে বলেন,’অশ্বথামা হত’ এবং সাথে খুবই নীচু স্বরে বলেন ‘ইতি গজ’। আদপে সত্যি বললেও গলার এই তফাতে দ্রোণ পুত্রশোকে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। যুধিষ্ঠির সম্পূর্ণ মিথ্যে না বললেও তা ছিল অর্ধসত্য। এছাড়া আরও তিনবার যুধিষ্ঠির মিথ্যের পরিচয় দিয়েছেন কিংবা বলা ভালো সত্য গোপন করেছেন। একবছরের অজ্ঞাতবাসে বিরাট রাজার দরবারে নিজের ও দ্রৌপদীসহ সমস্ত ভাইয়ের মিথ্যে পরিচয় দেন। একচক্রা নগরীতে থাকাকালীন মা কুন্তী ও চারভাইকে ব্রাক্ষ্মণ বলে পরিচিত করেন। এমনকি দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ব্রাহ্মণ আসনে স্থান নেন এবং ব্রাহ্মণ হয়েই অর্জুনকে আদেশ দেন লক্ষ্যভেদে।
মহাভারতের লেখনীতে যুধিষ্ঠিরের এতগুলো মিথ্যে থাকা সত্ত্বেও সত্যের প্রতীক হিসেবেই দেখা হয় তাঁকে। কারণ তাঁর মিথ্যে কখনো অন্যের ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায় নি। তাই সেগুলি পাপের আওতায় পড়েনা। তবে গুরু দ্রোণের সাথে ঘটা ওই অর্ধ মিথ্যাচারের জন্য তাঁকে নরক দর্শনের কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। শাস্তির এই বৈষম্যতা দিয়ে এটা পরিষ্কার যে আত্মরক্ষা বা অন্যের ক্ষতির কারণ না হওয়া মিথ্যে কখনো পাপের অংশ নয়। কিন্তু যে মিথ্যের ফলে অন্যের জীবনে অভিশাপ আছড়ে পড়ে তার উপযুক্ত শাস্তি অবশ্যই প্রাপ্য। এমন চুলচেরা বিশ্লেষণর মাধ্যমে ব্যক্তি চরিত্রকে আরও নিঁখুত করতে আজও তাই মহাভারত এক অন্যতম পথপ্রদর্শক হয়েই দাঁড়িয়ে।
Discussion about this post