শরৎ মানেই বাঙালির কাছে উৎসবের মরসুম। দুর্গোৎসবের পাশাপাশি এই সময়েই বঙ্গবাসী মেতে ওঠেন কালী শক্তির আরাধনায়। প্রতি বছর কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে মা কালীর পুজো হয়। বঙ্গদেশের কালীপুজোর ইতিহাস খুব প্রাচীন না হলেও বাংলার প্রতিটি জায়গার কালীপুজোর সাথে জড়িয়ে আছে বহু প্রাচীন মাহাত্ম্য ও ইতিহাস। নদিয়ার সুপ্রাচীন কালীপুজোগুলির মধ্যে অন্যতম নবদ্বীপের ঐতিহ্যবাহী আগমেশ্বরী মাতা। প্রতিবছর কালীপুজোর দিন বিশাল আকৃতির মাতৃমূর্তি মূল মন্দিরের সামনে স্থাপন করে পূজা করা হয় মা শ্যামার।
প্রাচীন এই মন্দিরে রয়েছে পঞ্চমুন্ডির আসন। তবে তা সত্বেও এখানে মায়ের পূজা হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় মতে। কোনও বলি বা কারণ সুধা ব্যবহার করা হয় না এই পূজাতে। এখানে মা দক্ষিণা কালী রূপে পূজিত হন। কথিত আছে, প্রায় ৫০০ বছর আগে মাতৃ সাধক আগমবাগীশের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল এই পূজা। নদিয়ার নবদ্বীপেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কৃষ্ণানন্দ। তার আসল নাম ছিল কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য। আগম পদ্ধতিতে সিদ্ধি লাভ করে তিনি ‘আগমবাগীস’ উপাধি পান। তার হাত ধরেই সর্বপ্রথম দক্ষিণা মায়ের পূজা শুরু হয়। ১৭০টির মতো বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে তিনি “বৃহৎ তন্ত্রসার” গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
তার এই দক্ষিণা কালী মাতৃমূর্তি স্থাপনের পেছনে রয়েছে রোমহর্ষক কাহিনী। কথিত আছে, মাতৃ সাধনা করার সময় কোন একদিন আগমবাগীশ মায়ের সাকার রূপ দর্শন পেতে মায়ের কাছে আকুতি মিনতি করতে থাকেন। তখন তিনি স্বপ্নাদেশ পান যে ঘুম থেকে উঠে সর্বপ্রথম যেই নারীমূর্তি কে তিনি সম্মুখে দেখতে পাবেন সেটি হবে মায়ের আসল আকৃতি এবং সেই রূপে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তিনি মাকে পূজা করতে পারেন। সেই মতো তিনি ভোররাতে গঙ্গা স্নান করার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে তিনি দেখতে পান কৃষ্ণ কালা এক গোয়ালিনী মহিলা এক মনে গাছের গায়ে ঘুঁটে দিচ্ছেন। বাঁ হাতে গোবরের তাল, ডান হাত তুলে গোবর দিচ্ছেন, পরণের কাপড় হাঁটুর ওপরে, কুঞ্চিত কেশরাশি কোমর ছাপিয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই, কৃষ্ণবর্ণা, কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে সিঁদূর লেপ্টে গেছে। এ হেন অবস্থায় পরপুরুষ কৃষ্ণানন্দকে দেখেই বধূ জিভ কেটে ফেলে, তার ডান পা অগ্রে প্রসারিত হয়। এই চিত্রই মানসপটে এঁকে গঙ্গামাটি দিয়ে মূর্তির রূপ দেন কৃষ্ণানন্দ। বর্তমানে এই দক্ষিণাকালী রূপেই বহু স্থানে মায়ের পুজো হয়।
আগমসিদ্ধ কৃষ্ণানন্দের মূর্তিই “রীঁ মাতা আগমেশ্বরী” নামে নবদ্বীপ সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খ্যাত। প্রাচীন কালে কৃষ্ণানন্দ একই দিনে মূর্তি গড়ে পূজা করতেন ও পরের দিন তা ভোরে বিসর্জন দিতেন। তবে সময়ের সাথে বদলেছে বেশ কিছু নিয়ম। বর্তমানে একাদশীর দিন থেকে মাতৃমূর্তি তৈরি হওয়ার কাজ শুরু হয়। পূর্ণিমাতে করা হয় মায়ের চক্ষুদান। পুজো উদ্যোক্তাদের মতে, “সুদীর্ঘ সময়কাল ধরেই পরম নিষ্ঠার সাথে মায়ের পুজো করা হয়ে থাকে। প্রতি অমাবস্যাতে মায়ের পুজো করা হলেও দীপান্বিতা অমাবস্যায় প্রায় ৩০ ফুটের মূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয়। এই সময়ে আলোর মোড়কে সেজে ওঠে সারা মন্দির চত্বর।” পুজো শেষে একাধিক বাহক মাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে স্থানীয় পীরতলা খালে বিসর্জন দেন।
Discussion about this post