“মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি”, কবি অনেক দিন আগেই বলে গেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি যা, তাতে আমাদের এই মহামারী নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল। কিন্তু আজ তো বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই সময় দাঁড়িয়ে এই কথাটার গুরুত্ব ঠিক কতটা, তা কিন্তু সবাই জানে। সবাই বোঝে পরিবেশকে রক্ষা করা দরকার, তাকে পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার, তার পরিচর্যার দরকার। কিন্তু যখন সময় আসে বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধার, তখন আমরা ভুলে যাই সব। এর ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমরা শুধু মাত্র ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান’ ধারণায় বিশ্বাসী, ‘গাছ বাঁচান, প্রাণ বাঁচান’-এ নয়। কারণ আমাদের দরকার একটা প্ল্যাটফর্ম, একটা ব্যানার, আর প্রচার। আজকাল বিভিন্ন এনজিও তুলছে ফান্ড। সেই ফান্ডের অর্থে কেনা হচ্ছে চারা গাছ। তারপর তো আছেই চারাগাছ বিলি, কিছু প্রতিশ্রুতি ও তার সঙ্গে অবশ্যই একটা গাছ দশজনে ঘিরে ফটো সেশন। কিন্তু এই চারাগাছগুলো লাগানোর পর তার খেয়াল রাখে ক’জন?
একটা ছোট উদাহরণ তুলে ধরা যাক। কর্মসূচি নেওয়া হল কোনও একটি রাস্তার দু’পাশে বসানো হবে এক হাজার গাছ। এনজিও এল। গাছ বসিয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করলেন কোনও এক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। যথারীতি চলল প্রচার। কিছুদিন পর অনতিদূরে আর একটি রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য কেটে ফেলা হল রাস্তার দু’পাশের হাজার হাজার গাছ। তখন দেখা মিলবেনা সেই এনজিওর, পাবেন না সেই খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বেরও। আসলে আমরা এই ঝাঁ-চকচকে বর্তমানেই আমরা বাঁচতে চাই। আমরা গাছের ছায়া খুঁজিনা, বরং খুঁজি বিলাসিতার এসি। তাই অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বাড়ির বাইরে বেরোতে গেলে আমাদের নিতে হবে কৃত্রিম অক্সিজেনের সিলিন্ডার। সোনার দরে বিক্রি হবে অক্সিজেন।
আমরা ভুল করি, কিন্তু ভুল শোধরাই না। তাই আমরা আবার ভুল করি। কয়েক মাস আগেকার কথা। আমাজন অরণ্যে দগ্ধ হয়ে শেষ হয়ে গেল লক্ষাধিক বন্যপ্রাণ। অস্ট্রেলিয়ায় ঝলসে যাওয়া বাচ্চা ক্যাঙ্গারুটাও বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল আগুন থেকে। কিন্তু পারেনি। অসহায় চিতাবাঘটা পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণীর তকমা সেদিন ভুলে গিয়েছিল। সেও নিস্তার পায়নি। কার ভুলের মাশুল দিতে হল এতগুলো প্রাণকে? অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেখানে নদী গর্ভ থেকে অবৈধভাবে সোনা উত্তোলন। আমাজনের উপনদী জামিরা ও মাদিরা সহ গোটা এলাকার জলজ বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের মুখে। এ বোধহয় শুধু মানুষই করতে পারে।
রাষ্ট্রনেতাদের গালভরা বুলি এতদিন যা পারেনি, আজ কিন্তু তা প্রকৃতি করেছে নিজের ইচ্ছেয়। দূষণ কমেছে দিল্লির মত শহরেও। তাই আজ পাখিরা উড়ছে ধুলো-ধোঁয়াহীন আকাশে। কিন্তু আমরা আবারও ভুল করব। স্বাভাবিক জীবনে একবার ফিরতে পারলে আমরা আবার হয়ে উঠব স্বেচ্ছাচারী। আবার ধোঁয়ায় ঢাকবে আকাশ, সমুদ্রের জলে ভিড় জমবে বর্জ্য ও প্লাস্টিকের, বাড়বে চোরাশিকারীদের দাপাদাপি। আর এতকিছুর পরেও আমরা আবারও স্লোগান তুলব “গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান”। আবারও ঘটা করে পালন করব ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। কিন্তু যতদিন না পরিবেশকে আমরা নিজেদের ভিতর বাঁচিয়ে তুলতে পারব, ততদিন সার্থকতা পাবেনা ৫ জুন দিনটির গুরুত্ব।
Discussion about this post