আজকের বাচ্চাদের হাতেখড়ির আগেই পরিচয় ঘটে সেলফোনের সাথে। তাই ফোনের খুঁটিনাটি থেকে ভিডিও গেম তাদের কাছে একরকম জলভাত। কিন্তু বর্তমানের এই প্রযুক্তিগত চাহিদায় কোথাও কি অবহেলিত গ্রামবাংলার সেই হাতে গড়া পুতুল? একটা সময় পাড়ায় পাড়ায় হাঁক শোনা যেত, ‘পুতুল নেবে গো পুতুল’। কচিকাঁচার ঝাঁক ছুট দিত। কিন্তু আজ সেইসব শিল্পের পরিণতিটা কি? আজও কি কারিগররা নির্বিকারে বানিয়ে চলে পুতুল? কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, তালপাতার পুতুল। চলুন আজ এমনই এক পুতুল মেলার সাথে পরিচয় করাই আপনাদের।
পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা। অগ্রদ্বীপ স্টেশন থেকে মিনিট দশেক হেঁটে গঙ্গানদী পার হলেই এক ছোট্ট গ্রাম, নতুনগ্রাম। আর সেখানেই বসে ‘অগ্রদ্বীপের মেলা’। এই মেলাটির ইতিহাস শুনলেও অবাক হবেন। বড়ই অদ্ভুত ও অনন্য। কথিত রয়েছে, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর এক সহচর ছিলেন গোবিন্দ ঘোষ। একদিন এক গৃহস্থের বাড়িতে দুপুরের খাবারের পর মুখশুদ্ধি হিসেবে হরিতকি টুকরো পান। সেটির অর্ধেক গোবিন্দ ঘোষ সঞ্চয়ে রেখে, বাকি অর্ধেক মহাপ্রভুকে খেতে দেন। এমন সঞ্চয় মনোভাব দেখে, মহাপ্রভু তাঁকে সংসারে থেকেই ঈশ্বর সাধনার নির্দেশ দেন। সেই মতোই অগ্রদ্বীপের নদীধারে তিনি বাড়ি করে গোপীনাথের বিগ্রহ স্থাপন করলেন। কিন্তু এত ভক্তির পরও তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের মৃত্যু হয়। আরাধ্য দেবতার ওপর ক্ষোভ জন্মায়। পুজো বন্ধ করেন তিনি। এমনকি আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও নেন। তখনই গোপীনাথ স্বয়ং এসে তাঁর পুত্র হিসেবে যাবতীয় কর্ম করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। সেই মতোই গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যুর পর গোপীনাথ শ্রাদ্ধ বসনে ভক্তের পিন্ড দিতে আসেন। চৈত্র মাসের একাদশীর সেই শ্রাদ্ধের তিথিকে কেন্দ্র করেই আজও চলে ‘চিঁড়ে মহোৎসব’। শুরু হয় পুতুল মেলা।
এই মেলাটি সাধারণ গ্রামবাংলার মেলার মতোই। হরেক মাল ১০ টাকা গোছের মেলা। তবে এই মেলাটিতে বিশেষ আলোকপাত করার বিষয় হল কাঠের পুতুল। যা আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। সারাবছরই ব্যস্ত থাকেন কারিগররা পুতুল বানাতে। তাঁদের মতে, “একটা পুতুল বানাতে বত্রিশবার হাত লাগাতে হয়।” রাধাকৃষ্ণ ও গৌরনিতাইয়ের কাঠের পুতুল দিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু আজ পেঁচা, বউপুতুল, বেনেপুতুলও তৈরী হয়। এসবের মধ্যে তিন কোণা পেঁচা বেশ জনপ্রিয়। মূলতঃ জনা ৪০ পরিবারের প্রধান জীবিকা ও বেঁচে থাকার রসদ হলো এই কাঠপুতুল। পুরুষদের সাথে সমানভাবে গ্রামের মহিলারাও এই কর্মযজ্ঞে সামিল হয়ে থাকেন।
সস্তা ও হালকা কাঠ, যেমন সজনে কুল জাতীয় নরম গাছের কাঠ দিয়েই তৈরী হয় লৌকিক পুতুলগুলো। প্রথমে কাঠগুলোকে রোদ-জলে ‘সিজন’ করা হয়। মাপ মতো কেটে নেওয়া হয় টুকরো। খোদাই বা কুন্দন কাজ চলে এরপর। দেশীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে কাঠ কেটে চাহিদা মতো আকার দেওয়া হয়। জোড়ামুখে এঁটেল মাটি দিয়ে গা করা হয় মসৃণ। খড়িমাটি লেপে রাখা হয় এরপর। সবশেষে রং লাগিয়ে সুন্দর সাজানো পুতুল। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, শ্রীরামপুরের মেলা থেকে শুরু করে রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় চাহিদা চোখে পড়ার মতো। বাচ্চাদের খেলার সাথী এরা হয়ত আজ নয়। তবে ড্রয়িংরুমের শোকেজ বিশেষভাবে দখল করেছে এই পুতুলগুলো।
চিত্র ঋণ – বরুণ দে, নির্ভীক কণ্ঠ – খাস খবরে
Discussion about this post